শেষমেশ পিসেমশাইটা ছিল, তাও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। তবে আর বাড়িটাকে ভুতুড়ে ছাড়া কী বলবে ঠাকুর? পুরনো লোক, সব কিছুই দেখছে বসে বসে। পুরনো মানুষ!
বিজয়ার কুদ্ধ গলায় ভয় পায় না। অবজ্ঞার গলায় বলে, ফেরেননি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। মানে আর আমি কী জানব? আমার তো মনে হল বরাবরের জন্যেই চলে গেলেন।
কেন কে জানে হঠাৎ বিজয়ার ভারী ভয় হয়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা বিদ্যুৎ শিহরণ অনুভব করেন বিজয়া। তবু ক্রুদ্ধ কণ্ঠটা বজায় রাখেন,ওঃ, তাই মনে হল তোমার? তা তাই যদি মনে হল, আমায় একবার বলতে পারলে না?
ঠাকুর সমান অবজ্ঞার গলায় বলে, আমি মাইনে করা লোক, আমি আপনাদের কী বলতে যাব? আর জানবই বা কেমন করে আপনারা জানেন না?
লোকটা বীরভূমের লোক, তেজী। রেখে-ঢেকে কথা বলে না।
.
বিজয়া উপরে এসে সরোজাকে ধরেন, ঠাকুরজামাই যে চলে গেল, সেটা আমায় একবার জানানো দরকার মনে হল না?
সরোজাক্ষ বিজয়ার কথায় কমই কর্ণপাত করেন, কিন্তু ওই চলে গেল শব্দটায় চমকে তাকালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, কোথায় চলে গেল?
সরোজাক্ষ আজ তিনদিন ধরে মনকে সংকল্পে স্থির করছেন, আবার ফিরে যাব কলেজে। মাথা হেঁট করে বলব, আমি ভুল করেছিলাম।
কিন্তু সংকল্পে স্থির হলে কী হবে, কোথায় গিয়ে বলবেন? কাকে বলবেন? কলেজে তো অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ছাত্র-ধর্মঘট চলছে। সরোজাক্ষ সঠিক জানেন না কী তাদের দাবি। হয়তো পরীক্ষা পিছিয়ে দেবার দাবি, হয়তো প্রশ্নপত্র সহজ করার দাবি, হয়তো বা কোনও প্রফেসর বা স্বয়ং অধ্যক্ষকেই বরখাস্ত করা হোক দাবি। মোট কথা, কোনও একটা দাবিরই লড়াই এটা। এই লড়াইয়ের প্রথম সোপানস্বরূপ অধ্যক্ষকেও একদিন ঘেরাও করেছিল তারা, কিন্তু তাতে তেমন লাভ হয়নি। অতএব ধর্মঘট!
সরোজাক্ষ কোথায় গিয়ে পেশ করবেন তাঁর আবেদন?
সরোজাক্ষ কি তবে কলকাতার বাইরের কোনও শিক্ষায়তনে আবেদন করতে যাবেন? যেখানে বিজয়া যাবে না, যাবে না সরোজাক্ষর বাকি সংসার। সরোজাক্ষ একা থাকবেন ছোট একটি কোয়ার্টার্সে। হয়তো তেমনভাবে থাকতে পেলে, এখনও নিজেকে খুঁজে পাবেন সরোজাক্ষ। নিজেকে বুঝতে পারবেন।
সংসারের জন্যেও অবশ্য কর্তব্য আছে। সে কর্তব্য পালনের উপকরণ তো টাকা? সরোজাক্ষ নিতান্ত কৃচ্ছসাধন করে থেকে পাঠিয়ে দেবেন সেটা।
এই ধরনের একটা স্বপ্নজগতে বাস করছিলেন সরোজাক্ষ, সেখানে বিজয়ার প্রশ্নটা যেন পাথরের টুকরোর মতো এসে লাগল।
সারদাপ্রসাদের সেদিনের সেই মর্মাহত মুখটার ছবিটাকে সরোজাক্ষ যেন সভয় আতঙ্কে অনুভূতির ঘর থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন, সাহস করে একবারও খোঁজ করে দেখেননি সারদার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কেন?
যখনই ঘর থেকে বেরোচ্ছিলেন, একটা অপরিচিত দৃশ্য যেন সরোজাকে পাথর করে দিচ্ছিল। সারদাপ্রসাদের দরজায় পরিপাটি করে পরদা ঝোলানো। সারদাপ্রসাদ কি ওর লেখাগুলো সব নষ্ট করছে বসে বসে ওর অন্তরালে?
হাসলেন যে? হাসলেন কেন?
এ প্রশ্নটা কার?
কার এই রুক্ষ কঠিন কণ্ঠস্বর? যে-স্বর সরোজাক্ষকে অবিরত কাঁটার চাবুক মারছে? যে-স্বরের আওতা থেকে পালাতে চাইছেন সরোজাক্ষ?
কিন্তু একথা কি ভেবেছিলেন সরোজাক্ষ, সেই স্বরটাই তাঁর থেকে অনেক দূরে চলে যাবে? সরোজাক্ষকে মুক্তি দিয়ে যাবে?
সরোজাক্ষ তাই চমকে উঠে বললেন, কোথায় চলে গেছে?
ন্যাকা সাজছ কেন? তুমি জানো না?
না।
সেদিনের সেই টাকার ঘটনাটাই বা কী শুনি?
জানি না।
তোমাকেও কিছু বলে যায়নি, একথা বিশ্বাস করব আমি?
সরোজাক্ষ নীরব।
বিজয়া আবার বলেন, যাবার সময় তোমাকেও কিছু বলে যায়নি?
সরোজাক্ষ নিরুত্তর।
বিজয়া রুষ্ট ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, যদি সত্যিই চলে গিয়ে থাকে, তো আমার দুর্ব্যবহারে যায়নি। গেলে তোমার দুর্ব্যবহারেই গেছে, সেটা মনে রেখো।
সরোজাক্ষ চোখ তুলে আস্তে বলেন, মনে রাখব। সারাজীবন মনে রাখব।
খোঁজ করবে না?
না।
বিজয়া ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।
সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ান।
নাট্য-শেষের যবনিকার মতো সম্ভাবনাহীন ওই পরদাটা যেন বিজয়ার দিকে ব্যঙ্গদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন এখুনি বলে উঠবে, কেন? এখন মনটা এমন হু হু করে উঠছে কেন? এই তো চেয়েছিলে চিরকাল।
চেয়েছিলেন।
কিন্তু চাওয়াটা পাওয়ার চেহারা নিয়ে এসে ধরা দিলে যে এমন বীভৎস লাগে তা তো জানা ছিল না বিজয়ার।
সরোজাক্ষও আস্তে বেরিয়ে এলেন, চুপ করে তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে, যেখানে সারদাপ্রসাদের মতো একটা অবোধ অজ্ঞান মানুষ হঠাৎ বোধের ধাক্কায় ছিটকে চলে যাবার সময় চিরদিনের মতো একটা যবনিকা টেনে দিয়ে গেছে।
হ্যাঁ, সরোজাক্ষও টের পাচ্ছেন চিরদিনের মতো। কারণ সরোজাক্ষ বিষবাণ খাওয়া একটা হৃদয় দেখতে পাচ্ছেন, সরোজাক্ষ রুক্ষ বিদীর্ণ একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন হাসলেন যে? হাসলেন কেন?
.
খবরটা নীলাক্ষ তার স্ত্রীর কাছে পায়নি, সংসারের যাবতীয় গুঢ় আর গোপন খবর যার কাছে পাবার কথা। স্ত্রী তো তাকে ব্যঙ্গ করেই উড়িয়ে দিল।
খবর দিল ময়ূরাক্ষী।
দেশ ভ্রমণ সেরে কলকাতায় ফিরেই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল ময়ূরাক্ষী আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে, গৌরবে ঝলসাতে ঝলসাতে। বিজয়া সেই গৌরব আহ্লাদের দিকে দৃষ্টিপাতমাত্র না করে নিভৃতে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে মুহূর্তে পাথর করে দিলেন।