না, তা থাকত না, থাকত স্নেহ, সদয়তা।
অথচ সে কথা আর এখন বলা যাবে না। সারদাপ্রসাদও আর সেই মধুর মিথ্যার স্মৃতিকে মধুর ভাবতে পারবে না। সারাজীবনের সমস্ত স্নেহ প্রশ্নগুলোই ব্যঙ্গের শর হয়ে শরশয্যায় রেখে দেবে সারদাপ্রসাদকে।
চক্ষুষ্মান সারদাপ্রসাদ এখন প্রতিক্ষণ অনুভব করবে, কী অনধিকারের ভূমিতে দাবির অহংকারে স্ফীত হয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে এসেছে সে।
এখন সারদাপ্রসাদ বুঝতে পারছে নীলাক্ষ নামের ঔদ্ধত্যটার চোখে কোন ছবি ছিল৷ ময়ূরাক্ষী নামের অসহিষ্ণুতাটার চোখে কোন বিষ। বিজয়া নামের অহমিকাটির চোখে কী অবজ্ঞা।
অনেক দূরে চলে না গেলে বুঝি ক্যামেরার লেন্সে এত স্পষ্ট মূর্তি ধরা পড়ে না।
একদা সরোজাক্ষই সারদার খবর নিতেন। এখন সরোজাক্ষ স্তব্ধ হয়ে গেছেন। তাই সারদার চলে যাবার খবরটা প্রথম টের সরোজা পাননি, পেলেন বিজয়া, সারদাপ্রসাদ সম্পর্কে যাঁর অবজ্ঞা এবং ঔদাসীন্য ছাড়া আর কিছু ছিল না।
কিন্তু কৌতূহল আর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল সারদা সেই টাকাটা দিয়ে।
উদগ্র একটা কৌতূহল আর তীব্র একটা হায় হায় নিয়ে বিজয়া বারবার পুজোর ঘর থেকে নেমে এসে খোঁজ করেছেন ওই হতভাগ্য মানুষটার, কিন্তু দেখেছেন সে সবসময়ই অনুপস্থিত।
তা ছাড়া–যে দরজার পরদাটা সর্বদাই দরজার মাথার কাছে ডেলা পাকিয়ে গোটানো থাকত সেটা সর্বদাই ঝুলে রয়েছে যেন একটা বোবা নিষেধের ভঙ্গিতে।
বিজয়া না বুঝে শূন্য ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হাঁক পেড়েছেন, কী গো ঠাকুরজামাই, তোমার আবার তোমার শালার মতন পরদা বাই হল কেন? ওলটাও দিকি। একটা কথা আছে।
পরদা তিনি নিজে সরাতে পারেন না, কারণ পুজো করতে করতে শুচিবস্ত্রে নীচে নেমেছেন।
অতএব কণ্ঠস্বরকেই পরদায় পরদায় তুলেছেন, কী ব্যাপার, এই ভরসন্ধেতেই ঘুমিয়ে কাদা হলে না কি গো? বলি ও মান্যমান মশাই, একটা অধম মানুষ যে এত ডাকছে, গ্রাহ্যি নেই?
একবার দুবার তিনবার।
অতঃপর বুঝেছেন, ঘরে নেই লোকটা।
কিন্তু সেই নোটের গোছর দৃশ্যটা যে মর্মে বিধে আছে। লোকটাকে না পেলে তার রহস্য উদ্ধার হবে কী করে? বারবার এসে এসে দেখেছেন বিজয়া, ঘরে আছে কিনা সারদাপ্রসাদ নামের মূর্খটা।
কিন্তু কোথায়? কোনও সময়ই নেই।
অবশেষে দিন তিন-চার পরে সন্দেহ হল। একতলায় নেমে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, ঠাকুর, পিসেমশাই খেয়ে বেরিয়ে গেছে?
ঠাকুর চোখ কপালে তুলে প্রতি-প্রশ্ন করল, পিসেমশাই?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আকাশ থেকে পড়লে যে! বলছি এতখানি বেলা হয়ে গেল, এখনও ফেরেনি মানুষটা, জিজ্ঞেস করছি খেয়ে বেরিয়েছে তো?
ঠাকুর এবার কপাল থেকে চোখ নামিয়ে যা বলে, তার সারমর্ম হচ্ছে, পিসেমশাইয়ের কথা আজ নতুন করে হঠাৎ কেন? তিনি তো আজ চারদিন হল হাওয়া। কেন, মা সেকথা জানেন না? ঠাকুরকে তো বলে গেছেন তিনি, ঠাকুর, তুমি আর আমার জন্যে চাল নিও না, আমি চলে যাচ্ছি। ঠাকুর সৌজন্য করে বলেছিল, কবে ফিরবেন? বলে গেছেন, জানি না, ঠিক নেই।মা এসবের কিছু জানেন না?
বিজয়ার গৃহিণীগর্বে আঘাত লাগে।
বিজয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, জানব না কেন। ঢং করে যাই বলে যাক, কাল তো তার ফেরার কথা ছিল। ফেরেনি মানে?
ঠাকুর মনে মনে একটু মুচকি হাসে।
এই কালকে ফেরার কথাটা যে সম্পূর্ণ বাজে কথা তা বুঝতে দেরি হয় না তার। শুধু বুঝতে পারে না পিসেমশাই সম্পর্কে হঠাৎ মার এত দরদ উথলে ওঠবার হেতু কী! সে লোকটার খাওয়া সম্পর্কে মাকে তত বেজারই দেখেছে ঠাকুর বরাবর। বাবুই খোঁজ করেছেন, লক্ষ্য করেছেন, ভাল জিনিস আনিয়েছেন।
ইদানীং বাবুরও ছাড়া-ছাড়া ভাব, রান্নাঘরেও সমারোহ নেই, পিসেমশাইয়েরও আগের মতো সেই আরাম আয়েসে ভোজনপর্বটি নেই। কখন হঠাৎ বেরিয়ে যায়, কখন হঠাৎ ফেরে, কখনও ব্যস্ত হয়ে নেমে এসে নিজেই জল আর আসন নিয়ে রান্নাঘরেরই একপাশে বসে পড়ে বলে,ঠাকুর, ভাত হয়ে থাকে তো আমায় দুটি দিয়ে দাও তো। থাক, থাক, মাছ-তরকারি না হোক, ডাল হয়েছে তো? ওতেই হবে।
কোনওদিন বা বেলা দুটো-তিনটের সময় অস্নাত অভুক্ত পরিশ্রান্ত চেহারা নিয়ে এসে বলেছে, ঠাকুর, বড্ড বেলা হয়ে গেল! তুমি বেচারি এখনও বসে আছ কেন? ঢাকা দিয়ে রেখে চলে গেলেই পারতে।
অপ্রতিভ ভাবে মাথায় দুবালতি জল ঢেলে জলঝরা গায়েই এসে খেতে বসেছে।
লোকটার উপর ঠাকুরের কেমন একটা মমতা ছিল বলেই বসে থাকত হাঁড়ি নিয়ে। মা সে খবর রাখতেন না বলেই, রাখলে, নির্ঘাত হুকুম দিতেন, বসে থাকবার দরকার নেই, ভাত ঢেকে রেখে দাও।
সেই মা আজ হঠাৎ পিসেমশাইয়ের সম্বন্ধে এত ব্যস্ত! লোকটা যে আজ চারদিন আগে চলে গেছে, সে খবরও রাখেন না গিন্নি!
ঠাকুর তার কর্মদশায় সারদাপ্রসাদকে কোনওদিন চলে যেতে দেখেনি। তাই তারও যেন মনে হয়েছিল এই চলে যাওয়াটা একেবারেই চলে যাওয়া। ওই চাল নিতে বারণ করার সময় ভয়ানক একটা যন্ত্রণার মুখ দেখেছিল ঠাকুর।
কিন্তু সে রাঁধুনি মানুষ, কাকে কী জিজ্ঞেস করবে?
তা ছাড়া বাড়িটা কি আর আগের মতো আছে? যেন ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে গেছে। মা অবশ্য চিরদিন উপরতলাবাসিনী, কিন্তু বউদি, দাদাবাবুরা, দিদিমণিরা, পিসেমশাই, এরা তো মাতিয়ে রাখত বাড়িটা। কিন্তু ক্রমে ক্রমে কী হয়েই গেল। বড়দিদির বিয়ে হয়ে গেল, ছোড়দা বিদেশে চলে গেল। বড়দাদাবাবু মদ ধরল, বউদি তার সঙ্গে সুর ধরল, ছোড়দিও কেমন কেমন হয়ে গেল। তারপর তো চলছেই ভাঙন। বাবু কাজ ছেড়ে দিয়ে ডোম্বল হয়ে বসে আছে, ছোড়দি ঘর থেকে বেরোয় না, খায় না দায় না, বড়দা বেহেড় হয়ে বাড়ি ফেরে, আবার তো ছোট্ট ছেলেটাকে বোর্ডিঙে না কোথায় রেখে এসেছে। ছেলেটা সেইখানেই থাকে, ছুটি হলে মামার বাড়ি যায়।