মীনার!
হ্যাঁ। রাতদিন দেখি ঘরে শুয়ে আছে, কলেজেফলেজেও যাচ্ছে না নাকি?
রাতদিন?
সুনন্দা আবার হি হি করে হাসতে থাকে। তুমি এত দেখার সময় পেলে কোথায় গো! তুমি যে আমায় চমকে দিলে! অ্যাাঁ, রাতদিন বাড়ির কে কী করছে, তার খবর রাখছ তুমি?
.
হৈমবতীও সরোজাক্ষর মতোই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কী এ?
সারদাপ্রসাদ অনুত্তেজিত শান্ত গলায় বলল,আপনার সেই টাকাটা।
আমার টাকা! হৈমবতী প্রমাদ গোনেন। পাগলা খ্যাপা মানুষটা কী বুঝতে কী বুঝেছে। তাই আকাশ থেকে পড়া গলায় বলেন, কোন টাকা?
সারদাপ্রসাদ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেয়ালের মতোই ভাবশূন্য গলায় বলে, বইয়ের ছুতো করে যেটা ভিক্ষে দিয়েছিলেন আমায়।
সদা-উত্তেজিত সারদাপ্রসাদের এই শান্ত মূর্তি আর ঠাণ্ডা স্বর হৈমবতাঁকে রীতিমত ভীত করে।
তা ছাড়া শুধুই কি কণ্ঠস্বর?
ভাষা নয়?
এই কি সারদাপ্রসাদের ভাষা?
চির সরল, চির শিশু সারদাপ্রসাদের?
হৈমবতী ভীত গলাতেই বলেন,আমি তো তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না সারদাপ্রসাদ!
সারদাপ্রসাদের ঘাড়টা আরও মোচড় খায়।
সারদাপ্রসাদ যেন সাদা দেয়ালের গায়ে অদৃশ্য কালিতে লেখা কোনও লিউপর পাঠোদ্ধার করছে।
হৈমবতী একটু অপেক্ষা করে আবার বলেন, কী হয়েছে বলে তো ঠিক করে। আমি তো সত্যিই বুঝতে পারছি না ।
সারদাপ্রসাদ তবু ঘাড় ফেরায় না।
সারদাপ্রসাদের সেই শান্ত স্বর আরও শান্ত, আরও দৃঢ় শোনায়, আমি বোকা–মুখ, নির্বোধ অন্ধ, আমার পক্ষে অনেক কিছুই বোঝা শক্ত, কিন্তু আপনার তো বুঝতে না পারার কিছু নেই খুড়িমা! তবে আপনাকে আমি বিশ্বাস করতাম। নির্বোধ পেয়ে আপনিও আমায় ঠকাবেন, এ ধারণা ছিল না। মূর্খের শিক্ষা বোধ হয় এইভাবেই আসে। যাক, কী বলতে কী বলছি, অপরাধ নেবেন না। আপনার টাকাটা কোনও কাজে লাগল না, তাই রেখে গেলাম। যে ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোর ছুতো করে ওটা দিয়েছিলেন, সেগুলো রান্নার উনুনে ফেলে দেবেন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে সারদাপ্রসাদ, কোনওদিকে না তাকিয়েই আস্তে আস্তে নেমে যায়।
হৈমবতী পাথরের পুতুলের মতো তাকিয়ে থাকেন সেই চলে যাবার দিকে।
ওই চলে যাবার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ থাকে না তাঁর, এ যাওয়া চিরদিনের জন্যে যাওয়া। ওই দীর্ঘ মাপের শিশু-মানুষটা আর কোনওদিন ফিরে আসবে না।
কিন্তু হৈমবতী ওকে আটকাবেন কোন উপায়ে?
হৈমবতী কি ছুটে গিয়ে ওর হাত ধরে বলবেন, পাগল ছেলে, চলে অমনি গেলেই হল? সব কথা না বলে কেমন তুমি চলে যাও দেখি?
না কি এখনও আবার পুরনো ভঙ্গিতে উৎসাহভরে বলবেন, কী আশ্চর্য! কী বলছ তুমি? আমি বলে আমার নতুন ব্যবসার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কত স্বপ্ন দেখছি।
নাঃ এত নিষ্ঠুর হতে পারবেন না হৈমবতী, হতে পারবেন না অত খেলো।
তীক্ষ্ণবুদ্ধি হৈমবতীর পক্ষে অবস্থাটা অনুমান করা কঠিন হয় না, আর হঠাৎ নিজেকে ভারী ক্লেদাক্ত মনে হয় তাঁর।
মাথার মধ্যে সমস্ত কোষে কোষে একটা আহত কণ্ঠের তীব্র অভিযোগ যেন অবিরাম ধাক্কা দিয়ে চলে, নির্বোধ পেয়ে আপনিও আমায় ঠকাবেন, এ ধারণা ছিল না।
হ্যাঁ, অপরাধ করেছেন হৈমবতী।
নির্বোধ পেয়ে ঠকাতেই চেষ্টা করেছেন ওকে। একটা সরল বিশ্বাসী হৃদয়কে দুপায়ে মাড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ ভেবেছেন ওর ভাল করছি।
তার মানে ওকেই অন্ধ ভেবে নিশ্চিন্ত থেকেছি আমি, ভাবলেন হৈমবতী–নিজে যে কতটা অন্ধ সে খেয়াল করিনি। ও আমার দৃষ্টি খুলে দিয়ে গেল।
কিন্তু ওর দৃষ্টি খুলে দিল কে?
বিজয়া?
সরোজাক্ষ?
হায়, হৈমবতী কেন নিমিত্ত হলেন?
হৈমবতী টেবিলে পড়ে-থাকা টাকাগুলোর দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে বসে রইলেন।
.
অন্ধ যদি রুদ্র আলোর প্রহারে সহসা দৃষ্টিলাভ করে বসে, সে বুঝি চক্ষুষ্মনদের থেকেও সচেতন হয়ে ওঠে। তাই সারদাপ্রসাদ যাত্রাকালে বিদায় গ্রহণের পালা অভিনয় করে না। নিঃশব্দে কখন যেন চলে যায় চিরদিনের জন্যে।
তার এতদিনের অধিকৃত ঘরটায়, যে অধিকারটা সরোজা বাদে বাড়ির সকলেরই দৃষ্টিশূল ছিল, সেই ঘরটায় যেখানে যা ছিল সবই পড়ে থাকল অবিকল, অবিকৃত। শুধু তার বাকি ছেঁড়া কাগজের বস্তাগুলো, যেগুলো দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় খণ্ড রূপে প্রকাশিত হবার অপেক্ষায় দড়িবাঁধা পড়ে ছিল, সেইগুলোর জায়গাটাই শূন্য হয়ে গেল।
আর গেল সারদাপ্রসাদের জায়গাটা।
কিন্তু এ বাড়িতে তার কি কোথাও জায়গা ছিল, একমাত্র সরোজাক্ষর হৃদয়ে ছাড়া?
অথচ আশ্চর্য, সরোজাক্ষর নির্মমতাতেই বিদায় হয়ে গেল সে।
হয়তো এমনিই হয়।
সবচেয়ে প্রিয়জনের কাছ থেকেই সবথেকে বড় আঘাত আসে। তার ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়, অসতর্কতায়।
.
সারদাপ্রসাদ যে তার সমস্ত পদচিহ্ন মুছে নিয়ে চিরদিনের মতো চলে গেছে, এ সত্য ধরা পড়তে সময় লেগেছিল। কারণ ওটা কারও আশঙ্কার মধ্যে ছিল না। সারদাপ্রসাদ কখন বেরোয়, কখন ঢোকে, কতক্ষণ বাড়ি বসে থেকে জ্ঞানচর্চা করে, কে তার হিসেব রাখে? খোঁজ ছিল শুধু সরোজাক্ষর, কিন্তু সেটা ইদানীং নয়। ইদানীং তো দুজনেরই জীবন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। যখন সরোজাক্ষর জীবনটা ছিল আঁটসাঁট একটা কর্মের ছন্দে গাঁথা, আর সারদাপ্রসাদ ছিল ঘরকুনো, তখন সরোজাক্ষ প্রতিদিন সাড়া নিতেন কী খবর সারদা? নতুন কী আবিষ্কার করলে?
কিন্তু সে প্রশ্নের মধ্যে কি ব্যঙ্গ থাকত?