কেন? আমিও তো এম-এ পাশ।
সেকথা রাখ। ছেলে আর মেয়ে সমান নাকি?
হ্যাঁ, তখনও একথা বীরদর্পে চলত।
ছেলে আর মেয়ে সমান নাকি?
মার কাছে যুক্তি ছিল না। শুধু রায় ছিল। কারণ রায় মানবার লোক ছিল।
তাই সরোজাক্ষ মানসীকে অপ্রাপ্য বস্তু বলে আশার জগৎ থেকে বিদায় দিলেন। আর যখন বউদি তার ঘোট বোন উত্ত্যক্ত করতে লাগল বাবাঃ, এক কেলে শুঁটকির বিরহে যে তুমি নিজে কালিবর্ণ হয়ে গেলে,তখন কিছুদিনের জন্যে এলাহাবাদে পিসির বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন।
ওইখানেই ইতি। আবার ফিরলেন ম্লান গম্ভীর মুখ নিয়ে। যদিও
সরোজাক্ষ জানতেন প্রেমও নয় বিরহও নয়, এ শুধু একটা আশাভঙ্গের বেদনা। অধ্যাপকের মেয়ের সঙ্গে তাঁর হয়তো আঙুল গোনা কয়েকটি দিনের দেখা। তবুও–বেজেছিল বেদনা। তার কী হয়েছিল তার খবর পাননি কোনওদিন।
কিন্তু সরোজাক্ষ পাগলও নয়, বুন্ধুও নয় যে, সেই বেদনাকে সম্বল করে জীবন কাটিয়ে দেবার পণ করবেন।
সরোজা শুধু দৃঢ়স্বরে জানিয়েছিলেন, রোজগার না করে বিয়ে করব না।
নলিনাক্ষ ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করেছিলেন, আমার একমাত্র পুত্রবধূকে একমুঠো ভাত জোগানোর ক্ষমতা আমার নেই?
সরোজাক্ষ বলেছিলেন, তা নয়, ওটা আমার একটা খেয়ালই ধরুন।
হয়তো খেয়াল, হয়তো নীতি, হয়তো বা কিছুটা সময়ক্ষেপ। তবে বাপ-মা আর বেশি ব্যস্ত করেননি। তাঁরাও হয়তো ভেবেছিলেন বড় মাছকে টেনে তুলতে হলে প্রথমে সুতো কিছুটা ছাড়াই দরকার, হঠাৎ টান মারলে ছিঁড়ে যাবে।
তাঁরা শুধু তলে তলে পরমাসুন্দরী খুঁজছিলেন, বিত্তবানের কন্যা হওয়াও আবশ্যক। হাঘরের মেয়ে তাঁদের পছন্দ নয়। তা সরোজাক্ষর মা বাবা তাঁদের মানসকন্যাকে আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পিতা বিত্তবান, কন্যা অ-বিদুষী। আর রূপ? হ্যাঁ, এখন শুনলে অবিশ্বাস্য হলেও একদা বিজয়া রূপসী ছিলেন। রূপসী, স্বাস্থ্যবতী, নবযৌবনা সেই কন্যাকে ছেলের কাছে ধরে এনে দিয়ে মা বাপ আড়ালে মুখ টিপে হেসেছিলেন।
এক সময় পথ শেষ হয়।
গোরুর গাড়িও পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট জায়গায়।
নিতান্ত অন্যমনস্ক হয়ে চললেও অভ্যস্ত হাত যথাপথেই চালিয়ে নিয়ে যায়।
পকেট থেকে চাবি বার করে বাড়ির পাশের ছাড়া জমিটুকুতে চালা তুলে নেওয়া গ্যারেজটা খুলে ফেলে গাড়িটা ঢুকিয়ে দেন সরোজা, আবার তালাবন্ধ করেন, ধীরে ধীরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে আসেন।
সরোজাক্ষর বড় ছেলে নীলাক্ষ যে গাড়িটাকে মোচার খোলা বলে ব্যঙ্গ করে, হয়তো এটাও তার একটা কারণ। সরোজাক্ষর ওই স্বার্থপরের মতো কেবলমাত্র নিজের ব্যবহারের শেষে গাড়িটা তুলে ফেলা। কাউকে অফার না করা। নীলাক্ষর কি হাত নিসপিস করে না? ওই গাড়িটার ওপর হাত পাকিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না? কিন্তু মান খোয়াতে কে চায়?
অথচ এই এক অদ্ভুত মনোভাব সরোজাক্ষর। তোমরা যখন আমার সেন্টিমেন্টের মূল্য বোঝো না, গাড়িটাকে যে আমি ছোটকাকার ভালবাসার মূর্তি হিসেবে দেখি তা বোঝো না, ছোট বলে ব্যঙ্গ করো, দাতব্যের মাল বলে কৌতুক করো, তখন ঠিক আছে–চড়ো না কেউ।
বাড়ির মধ্যে ঢুকে এলেন সরোজা।
বাপের আমলের বাড়ি, সেকেলে ধরনের গড়ন। মাঝখানে উঠোন, চারপাশে ঘর। চারের একদিকে দুখানা বৈঠকখানা, একদিকে রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর খাবারঘর, একদিকে বাজে বাড়তি ঘর আর স্নানের ঘর, আর বাকি দিকটায় সিঁড়ি উঠে গেছে দালানের মধ্য থেকে।
কোথাও কারও সাড়া নেই, কারণ বিজয়ার এখনও ঠাকুরঘর থেকে নামার সময় হয়নি। নামলেই কুরুক্ষেত্র বাধবে। ঠাকুর-চাকরের এতক্ষণকার গাফিলি, বউমার অনুপস্থিতি, ছেলের বে-আক্কেল, আর সরোজাক্ষর ঔদাসীন্য, সব নিয়ে চেঁচাতে শুরু করবেন। স-পুরী একগাড়ে করে ছাড়বেন।
কিন্তু এখন বাড়িটা যেন থমথম করছে। সরোজা অনুমান করতে পারলেন, নীলাক্ষ সেই একবার টেলিফোন করে নিশ্চিন্ত হয়ে বেড়াতে বেরিয়ে গেছে। বিজয়ার নিশ্চিন্ত অনিশ্চিন্ততার প্রশ্ন নেই। তিনি যদি সত্যিই চিন্তিত হয়ে থাকেন সরোজাক্ষর দেরি দেখে, হয়তো কিছু হরির লুট মেনে বসেছেন।
আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন সরোজাক্ষ।
সিঁড়িটা নীচের তলার দালান থেকে উঠতে উঠতে একবার দোতলার দালানের মুখে ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়েই আবার একটা মোচড় খেয়ে বাঁক নিয়ে উঠে গেছে তিনতলার ইশারা বহন করে। কিন্তু ওর সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলে দেখা যাবে ইশারাটা মিথ্যা, তিনতলার ভরাটি দেহ কোথাও নেই। সিঁড়ির শেষটা খাঁ-খাঁ করা ন্যাড়া ছাদের মাঝখানে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ছাদটায় বর্ষায় বৃষ্টি পড়ে পড়ে শ্যাওলা জমে, আবার বর্ষার শেষে রোদের দাপটে সে শ্যাওলা শুকিয়ে উঠে কলাই ডালের খোসার মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে কোণে কোণে জমা হয়। তার খাঁজে খাঁজে খুদে খুদে আগাছার চারা জন্মায়। আবার দৈবাৎ কোনও একদিন সম্মার্জনীর মার খেয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তারা।
কারণ ছাদের সীমানায় সিঁড়ির ঘরটা বিজয়ার ঠাকুরঘর। কাজে কাজেই বিজয়া আদৌ পছন্দ করেন না ঝি-চাকররা যখন তখন হুট করে ঝাঁটা নিয়ে উঠে এসে আশ্রমপীড়া ঘটায়। তা ছাড়া দরকারই বা কি? ছাদে আসছেই বা কে? দেখছেই বা কে?
নিতান্তই যখন দেখা যায় জঞ্জালের ছিপিতে ছাদের রে ওয়াটার পাইপের মুখ বন্ধ হয়ে উঠেছে, তখনই বিজয়ার আদেশপত্র গিয়ে পৌঁছয় নীচের তলায়। কোনও একজন ঝাঁটাধারী সাবধানে এসে সাফ করে দিয়ে যায় বিজয়ার কড়া পাহারার শাসনতলে।