যেন মানানোর প্রশ্ন বিস্মরণ হয়ে নিজেই গাড়িটা আহরণ করেছেন সরোজাক্ষ। তবু মন্তব্যের ভঙ্গি এমনি তীব্র আর নিরাবরণ বিজয়ার।
হয়তো বিজয়ার গাড়িটার প্রতি এই সপত্নীর ঈর্ষা হত না, যদি সরোজাক্ষ তাঁকে ওই গাড়ি চড়িয়ে কালীঘাট গঙ্গার ঘাট করিয়ে বেড়াতেন, কিন্তু আশ্চর্য, কোনওদিন সে প্রস্তাব করেন না সরোজা। একদিনও করেননি।
বিজয়া কি নিজে মান খুইয়ে বলতে যাবেন?
তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কানে কি আর তোলেন না কথাটা? কোনও কাউকে মাধ্যম করে সরোজাক্ষর কানের কাছে কি উচ্চারণ করেন না, কালী গঙ্গা? ঠাকুর মন্দির? হুঁ, পারতাম ছোটখুড়ির মতো বুড়ো বয়েস অবধি পিঠে আঁচল ফেলে শাড়ি আর টাইট ব্লাউজ পরে সন্ধ্যাবেলা গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যেতে, তা হলে হয়তো ভাগ্যি ফিরত। দেখেছি তো খুড়িকে এ-যাবৎ। কে বলবে আমার থেকে আটন বছরের বড়। ছুকরিটি সেজে বরের পাশে বসে সিনেমা যাচ্ছেন, নিউ মার্কেটে যাচ্ছেন। বলি, শেষরক্ষা কি হল?
সরোজাক্ষ শুনতে পান।
কিন্তু সরোজাক্ষর চিরকালের পরম সাধনা, কানে তুলো দেওয়ার সাধনা। তাই বিজয়ার সব কথাই শূন্যে গদা ছোঁড়া। হয়তো এই ব্যর্থতার জ্বালা থেকেই বিজয়ার ভাষা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, জিভ আরও শাণিত হয়, কিন্তু সমোজাক্ষ আপন সাধনায় অবিচল থাকেন। সরোজাক্ষ কোনওদিনই বলে ওঠেন না, তোমার তা হলে শেষরক্ষার গ্যারান্টি আছে তো? শাড়ির বদলে গামছা সার করে, আর গোবর গঙ্গাজলের পারানি সঞ্চয় করে?
না, বলেন না, নীরবই থাকেন।
শুধু আজই হঠাৎ সরোজাক্ষ চিরদিনের সাধনা বিস্মৃত হয়েছিলেন।
সরোজাক্ষ ভাবতে চেষ্টা করলেন, পদত্যাগের প্রতিক্রিয়াটা কী হতে পারে? ঘরেবাইরে? অবশ্যই বাইরে সহস্র প্রশ্ন, আর বাড়িতে সহস্র শরাঘাত। পুরুষমানুষ রাগ করে উপার্জন ত্যাগ করতে চাইলে সংসার কবে তাকে ক্ষমা করে? কবে বলে থাকে–ঠিক করেছ। সত্যিই তো এমন অপমানের মধ্যে কখনও টেকা যায়? এ তো একদিনের ব্যাপার নয়, আবার হেঁট মাথায় ফিরে গেলে, রোজই করবে। তার চেয়ে এই ভাল।
বলে না।
বলতে পারে না। সমস্ত সম্পর্কই স্বার্থের শৃঙ্খলে বাঁধা। সেখানে এতটুকু টান পড়লেই কর্কশ শব্দ বেজে উঠবে।
অতএব ধরেই নিতে হবে, এ সংকল্প প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই খুব একটা অশান্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে সরোজাক্ষকে।
কলেজেও হয়তো সহজে গৃহীত হবে না সেই পদত্যাগপত্র। কর্তৃপক্ষ সম্ভ্রম-সম্মানের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব নিতে না পারলেও অনুরোধ-উপরোধ আসবে সেখান থেকে। কারণ সেটা স্বার্থের ব্যাপার। প্রফেসর মৈত্রর পড়ানোর সুনাম আছে। কথাটা ভেবে পরক্ষণেই লজ্জিত হলেন সরোজাক্ষ। শুধুই কি স্বার্থ? সরোজাক্ষকে সকলেই কি ভালবাসেন না? অন্যান্য অধ্যাপকেরা, স্বয়ং অধ্যক্ষ? দায়িত্ব তাঁদের নেবার ক্ষমতা নেই তাই। যে-কোনও মুহূর্তে তাঁরাও এইভাবেই লাঞ্ছিত অপমানিত হতে পারেন। এ আশঙ্কা আছে তাঁদের।
হঠাৎ একটু কৌতুক বোধ করলেন সরোজাক্ষ–আমরা কি তবে সেই দেশে বাস করছি, যে দেশের ব্যবহার বিধিতে বেড়ালরা পালায় নেংটি ইঁদুরদের দেখে!
তাই, তা ছাড়া আর কি।
ঘরে বাইরে কর্মক্ষেত্রে-মর্মক্ষেত্রে ওই মজার দেশেরই লীলা আজ।
.
পদত্যাগপত্রের বিষয়ে পরামর্শের কেউ নেই। নিজেকেই চিন্তা করতে হবে।
বিজয়া কোনওদিনই তাঁর মর্মভাগিনী নয়, বিজয়ার সঙ্গে তাঁর দুর গ্রহের ব্যবধান। বিজয়া কোনওদিনই সরোজাক্ষর রুচিকে, চিন্তাকে, ভাবধারাকে বুঝতে চেষ্টা করেননি। বিজয়া আপন স্থূলবস্তুর জগতে বিচরণশীল। যদিও বিজয়া ওই ব্যবধানটা অনুভব করতে পারেন। সরোজাক্ষর সৌজন্য ভদ্রতা আর শান্ত ব্যবহারের আবরণ তাঁকে সশ্রদ্ধ করতে পারে না। সেই অনুভূতিটা অতএব আক্রোশপরায়ণ করে বিজয়াকে।
বিজয়া তাই যেন ইচ্ছে করেই অধিকতর স্কুল হন, অধিকতর কর্কশ।
কিন্তু শুধুই কি ইচ্ছে করে?
বিজয়ার উপাদানে আর কী-ই বা আছে? আর কী-ই বা ছিল?
অথচ সরোজাক্ষর সমস্ত কল্পনার সমস্ত ভাবনার একটি শরীরিণী মূর্তি একদা চোখে পড়েছিল সরোজাক্ষর। সরোজাক্ষর মনে হয়েছিল মানসী শব্দটার প্রকৃত অর্থ জানতে পারলাম আজ।
কিন্তু সেটা এ যুগের ব্যাপার নয়।
সরোজাক্ষ তখন তরুণ যুবক, সদ্য এম-এসসি পাশ করে বেরিয়েছেন। মেয়েটি বি-এ পাশ করে এম-এ পড়বার জন্যে বায়না ধরেছে তার অধ্যাপক পিতার কাছে।
সরোজাক্ষরই অধ্যাপক তিনি।
সরোজাক্ষ তখনও রুজি-রোজগারে স্থিতিশীল হননি, তবু লজ্জার মাথা খেয়ে করে বসেছিলেন প্রস্তাব।
হয়তো সেই সঞ্চারিণী পল্লবিনী শ্যামাঙ্গীর কৃষ্ণকালো চোখ দুটির মধ্যে সে প্রস্তাবের প্রশ্রয় ছিল।
কিন্তু সরোজাক্ষর লজ্জার মাথাটা খাওয়াই সার হল। সরোজাক্ষর বাবা নলিনাক্ষ বলে উঠলেন, ওরা তো গাঙ্গুলি। তার মানে রাঢ়ী? তা হলে?
তা হলে যে কি, তার অজস্র উত্তর ছিল সরোজাক্ষর মনের মধ্যে, তবু সরোজাক্ষ সেই কুঞ্চিত জ্বর নীচে মাথা তুলতে পারলেন না।
সরোজাক্ষর মা বললেন, বি-এ এমএ পাশ মেয়ে, বউ হয়ে আসবে? তার মানে তুই বিয়ে করেই আলাদা হতে চাস?
মার সামনে একটু কথা বলেছিলেন সরোজা। বলেছিলেন,কেন, আলাদা হবার কথাই বা আসছে কেন? পাশকরা মেয়েরা কি বাঘ না ভালুক?
মা সতেজে বলেছিলেন,আমাদের কাছে তাই।