.
ঠিক এইভাবেই হয়তো ভাবছিলেন না সরোজাক্ষ, ভাবতে পারছিলেন না, শুধু যেন এক একটা ঢেউ উঠছিল চিন্তার সমুদ্রে।
এ যুগের এই সংকল্পের আভাস কি শুধু আজই দেখতে পেলেন সরোজাক্ষ তাঁর ক্লাসের কতকগুলো ছেলের চোখে? আপন সংসারের গণ্ডিতে দেখেননি? মাঝে মাঝে হঠাৎ কোনও একটি ঘটনার স্ফুলিঙ্গ দেখেননি তাঁর পরিচিত জগতের পরিধিতে?
তবে আজই হঠাৎ এমন বিচলিত হয়ে পড়লেন কেন? কেন তখন হঠাৎ করে মনে হল কোনও লুকোনো কার্নিসের খাঁজ থেকে বেরিয়ে এসে একঝাঁক চামচিকে তাঁর মুখের উপর দিয়ে উড়ে গেল? কেন মনে হল একটা কালো বাদুড় ডানা ঝাঁপটে চলে গেল তাঁর চোখের সামনে দিয়ে?
সরোজাক্ষ ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করছিলেন, কিন্তু সরোজাক্ষর ক্ষমা চাওয়াই উচিত হয়েছে। এত অল্পে বিচলিত হবেন কেন তিনি? তিনি কি আগামীকালের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন না? তিনি কি তার জন্যে নিজেকে একবিন্দুও প্রস্তুত করেননি? যদি না করে থাকেন সেটাই ভুল।
.
আস্তে আস্তে গাড়িটা চালাচ্ছিলেন সরোজাক্ষ, আস্তে আস্তে চিন্তার ভাঁজ খুলে খুলে যাচ্ছিল। আমি কি শুধু আজকেই হার মেনেছি? আমরা কি হঠাৎই কোনও একদিন পরাজিত হই? জন্মের শুরু থেকেই কি আমরা হার মানতে চলছি না?
জীবনের যে স্ফুলিঙ্গকণাটুকু নিয়ে আমাদের এত আস্ফালন, সেটা আমাদের সম্পূর্ণ হাতের বাইরের জিনিস। অনন্তকাল ধরে এই একটা আক্ষেপে মাথা খুঁড়ছে মানুষ
কোথায় ছিলাম কেনই বা এলাম
এই কথাটা জানতে চাই,
আসার কালে ইচ্ছাটা মোর।
কেউ তো কেমন শুধায় নাই।
তা হলে? তা হলে হচ্ছে এই–
আমার জন্ম আমার ইচ্ছাধীন নয়, আমার জীবনের পরিবেশ আমার ইচ্ছাধীন নয়। তবে এই পৃথিবীর লীলাটা আমার ইচ্ছাধীন হবে এমন বায়না করি কেন? আর বায়না করলেও যে কোনও লাভ নেই– সেও তো প্রতিপদে অনুভব করতে করতে এই প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পা দিয়েছি, তবু হঠাৎ বিচলিত হলাম, তবু সেই বায়নাটা করে মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম।
গ্লানি জমে উঠছে মনে।
যে রকম মৃদু গতিতে গাড়ি চালান, গতি তার চাইতেও মৃদু হয়ে যাচ্ছে, যেন ভুলে ভুলে যাচ্ছেন কোথায় যাবেন।
হ্যাঁ, গাড়িটা চালান সরোজা হাস্যকর রকমেরই মৃদুগতিতে।
সরোজাক্ষর বড় ছেলে বলে, বাবার মোচার খোলা গাড়ি, গোরুর গাড়ির স্পিড।
.
কিন্তু গাড়িটা কি সরোজাক্ষ নিজে কিনেছেন?
নাঃ, অধ্যাপক মানুষ, আর শান্ত স্তিমিত মানুষ, গাড়ি কিনবার সাধ তাঁর কোনওদিনই হয়নি, সাধ্যও না। বরং গাড়ি চড়ে কলেজ যেতে লজ্জাই পান, অনেকটা দূরে রেখে, পায়ে হেঁটে গিয়ে ঢোকেন। তবু এই গাড়িটা তাঁকে চড়তে হয়, চড়ে কলেজে যাওয়া-আসা করতেও হয়। সেও তো এক হার মানারই ব্যাপার।
স্নেহের আবদারের কাছে হার মানা।
নিঃসন্তান ছোট কাকার ভারী প্রিয়পাত্র ছিলেন সরোজা, কাকিরও। তাঁদের মনের জগতে ছেলের জায়গাটুকুতেই যেন সরোজাক্ষর স্থান ছিল।
বছর দুই আগে কাকা মারা গেলেন আর তখনই এল এই হার মানার পরিস্থিতি। কাকিমা বললেন, উনি বলে গেছেন গাড়িটা তোমায় দিতে।
সরোজাক্ষ বিচলিত গলায় বললেন,আমায় দিতে মানে? আমি গাড়ি নিয়ে কী করব?
চড়বে। কলেজ যাওয়া-আসা করবে। বড় শখের জিনিস ছিল ওঁর এটি, তাই যখন তখন বলতেন, আমি মরে গেলে তুমি যেন কে চালাবে ভেবে গাড়িখানা বেচে দিও না, গাড়িটা সরোজকে দিও।
সরোজাক্ষ অবশ্য এইটুকুতেই রাজি হননি, এ প্রস্তাবের প্রতিবাদের দিকে অনেক যুক্তি খাড়া করেছিলেন–লোকে হাসবে, ড্রাইভার রাখার পয়সা কোথা? নিজের অভ্যাস নেই।
কাকি উড়িয়ে দিয়েছেন সেকথা।
বলেছেন, চালাতে তো তুমি জানো একটু একটু, তা ছাড়া শিখে নেবে। তোমার কাকাও তো যখন গাড়ি কিনলেন, কিছুই জানতেন না, শিখে নিলেন। বলতেন, ব্যাপারটা কিছুই শক্ত নয়, একটু চোখ কান খোলা রেখে ঠাণ্ডা মাথা নিয়ে চাকাটা ধরতে পারলেই হল। কাকি একটু চুপ করে থেকে আবার বলেছিলেন,তুমি ওটা ভোগ করলে তিনি পরলোকে থেকেও তৃপ্তি পাবেন। তুমি ওতে চড়ে কলেজ যাবে আসবে।
আর কি করবেন সরোজাক্ষ?
কাকির চোখে জল!
কাকার পরলোকগত আত্মার পরিতৃপ্তির দায়িত্ব।
অতএব গাঢ় মেরুন রঙের ছোট ছিমছাম ওই গাড়িটি গ্রহণ করতে হল সরোজাক্ষকে নিশ্চয় ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কাকি বারবার সেই কথাই বললেন, কাউকে কিন্তু দিয়েটিয়ে দিও না বাপু, তুমি ব্যবহার করলেই তিনি পরিতৃপ্ত হবেন।
বিগত আত্মার পরিতৃপ্তি লাভের ক্ষমতা আছে কি না, অথবা প্রয়োজন আছে কি না, আর সত্যিই এই তুচ্ছ পার্থিব বস্তুর উপরে সে পরিতৃপ্তি নির্ভরশীল কি না, এ সব কুট প্রশ্ন তোলবার মতো প্রকৃতি নয় সরোজাক্ষর, তিনি তাঁর এই প্রায়-সমবয়সী অথচ স্নেহে শ্রদ্ধায় মাতৃস্থানীয়া মহিলার অনুরোধ ঠেলতে পারলেন না।
তদবধি ব্যবহার করছেন ওটা।
আস্তে আস্তে চালান, সযত্নে রক্ষা করেন। যেন কার গচ্ছিত ধন, যেন সে ফিরে এসে আবার ফেরত নেবে।
তা এই গাড়ি লাভের পর থেকেই যেন সহকর্মীদের আর ওঁর প্রতি তেমন সহানুভূতি নেই। যেন সরোজাক্ষ ওদের টেক্কা দিয়ে কোনও উচ্চস্তরে ওঠার চেষ্টায় হাত লাগিয়েছেন।
হয়তো সরোজাক্ষর আজকের দুর্দশায় তাই কেউ তেমন কাতর হয়নি। হয়তো ভেবেছে-কমুক, অহংকারটা একটু কমুক।
গাড়িটার জন্যে বাড়িতেও কি কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে থাকতে হয় না সরোজাক্ষকে? সরোজাক্ষর স্ত্রী বিজয়া কি বলেন না, অমন গাড়ির গলায় দড়ি! দুটো বই তিনটে মানুষের বসবার জায়গা হয় না, তাকে আবার গাড়ি বলে! ও গাড়ি ওই বাঁজা মানুষদেরই ভাল। ছেলেপুলের ঘরে গেরস্তপোষা গাড়ি নইলে মানায়? ছিঃ।