সংকল্পচ্যুত হলেন।
ক্ষমা চাইলেন।
উঠে দাঁড়িয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, তোমরা আমাকে ক্ষমা চাইতে বলেছ, এতক্ষণ ধরে আমি বিচার করে দেখছিলাম সেটা চাইবার মতো কাজ আমি করেছি কিনা।
ভিড়ের মধ্যে বেশ একটু গুঞ্জন উঠল।
অর্থাৎ হুঁ বাবা, পথে এসো।
অধ্যাপক মৈত্র কথা শেষ করলেন, দেখলাম ক্ষমা চাওয়াই উচিত। একা আমি নয়,সমস্ত প্রতিষ্ঠানটারই ক্ষমা চাওয়া উচিত। কারণ দিনের পর দিন তোমাদের আমরা ঠকিয়েছি। তোমাদের আমরা শিক্ষা সংস্কৃতি সভ্যতা শোভনতা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাশি রাশি টাকা নিয়ে চলেছি, কিন্তু দিতে পারিনি সে জিনিস। দিতে পারছি কি না তাকিয়েও দেখিনি। এই প্রতারণার জন্যে ক্ষমা চাইছি ।
আরও কিছু বলতেন হয়তো, ঘেরাও দলের পিছন থেকে মোরগ ডাক উঠল। তারপর অনেকগুলো গলার ছ্যাবলা হাসি-সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে কথা বলছে রে! ওসবে আর কিছু হবে না চাঁদ, সে দিন চলে গেছে।
সরোজাক্ষর যেন মনে হল কাছে কোথায় ফার্নেস জ্বলছে, তার হলকা আসছে কানে মাথায় মুখে। তবু কষ্টে বললেন, তা বটে। তবে এটা সাজানো কথা নয়। এই মুহূর্তে সত্যিই অনুভব করছি, তোমাদের আমরা ঠকিয়ে চলেছি। তোমাদের গার্জেনদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অর্থের সুযোগ নিচ্ছি, অথচ তাঁদের বিশ্বাসের মূল্য রাখছি না। বিবেকের কাছেই জবাব দেবার কিছু খুঁজে পাচ্ছি না, তোমাদের আর কী বলব। তবে মনে হচ্ছে হঠাৎ একদিন শাসন করতে বসাটা অন্যায় হয়েছে আমার। তার জন্যে ক্ষমা চাওয়া দরকার।
গুঞ্জনটা প্রবল হল।
অধ্যাপকের ক্ষমা চাওয়ার সুরের মধ্যে যেন অন্য অর্থ নিহিত রয়েছে। তথাপি অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়াটাও রয়েছে স্পষ্ট ভাষায়। কী তবে করা যায়? ছেড়ে দে বাবা, ছেড়ে দে। বলল একটা অশ্লীল গলা।
তারপর কারা যেন কাদের মিনতি করল, অনুরোধ উপরোধ শোনা গেল কিছু কিছু ধরে নে বাবা প্রথম অপরাধ–এই নিয়ে আর গণ্ডগোলে কাজ নেই। ক্ষমা চাওয়াটা তো পষ্ট প্রত্যক্ষ, সেই–সেইটাই রেকর্ড থাকবে–
অতঃপর ওরা ঘেরাওয়ের প্রাচীর ভেঙে ঈষৎ সরে গিয়ে যেন করুণার গলায় বলে উঠল,ঠিক আছে, চলে যান।
সরোজাক্ষ কোনওদিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে যেন কোনও অপরাধের নাটকের ধরা পড়া নায়কের মতো আস্তে আস্তে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
প্রাচীরের ভাঙা ইটের এক একটা খণ্ড বলে উঠল, এইটুকু তো আগে করলেই হত জাদু! মিথ্যে ভোগালেন।
তারপর শব্দ উঠল হুক্কা হুয়া। শব্দটা যেন অধ্যাপক মৈত্রকে তাড়া করে পিছু পিছু ছুটে আসতে লাগল।
আমি হার মানলাম।
মনের গভীরে নিঃশব্দ নিশ্বাসে উচ্চারণ করলেন সরোজা-ভাবিনি এরকমটা কখনও হবে। হয়তো আমারই ভুল হয়েছিল। ওরা ছাত্র, ওরা রাজনীতি নিয়ে উত্তেজিত হবে এটা স্বাভাবিক। আমরাও হয়েছি
সরোজাক্ষ একবার চিন্তাকে থামালেন–আমরাও হয়েছি কিন্তু সে কি এইরকম অসভ্য নির্লজ্জতায়? আমরাও উত্তেজিত হয়েছি, কিন্তু তার জন্যে কি ভাষার শালীনতা হারিয়েছি? তার জন্যে কি..না, কোনও একটা অদৃশ্য শক্তির ক্রীড়নক হয়ে ইচ্ছে করে মতলব করে কখনও উত্তেজিত হইনি আমরা। পরাধীনতার অপমানে উত্তেজিত হয়েছি। উত্তেজিত হয়েছি শাসকদের অনাচার দেখে, অত্যাচার দেখে, দেশের জনগণের নিশ্চেষ্ট ঔদাসীন্য দেখে। উত্তেজিত হয়েছি, বিচলিত হয়েছি।
কিন্তু এদের রাজনীতি আলাদা।
এদের উত্তেজনা উন্মাদনার উৎস অন্য। এরা মূঢ় অন্ধ, এরা একটা মতলবের শিকার মাত্র। তাই এরা
উত্তেজিত হয়ে ওঠে না, ইচ্ছে করে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এরা ছাত্র সেজে এসেছে, সত্যি ছাত্রদের ঘর পোড়াতে। তাই এই অগ্নিনাটকের সৃষ্টি।
সরোজাক্ষ এদের কথা জানেন না তা নয়। তবু সরোজাক্ষ কোনওদিন দুঃস্বপ্নেও ধারণা করতে পারেননি, তাঁরই দুগজ দুরে বসে এরা এমন করে বারুদ তৈরি করছিল, আর সে বারুদের প্রথম বলি হবেন সরোজাক্ষ নিজেই। অবশ্যই এর পর অধ্যয়ন অধ্যাপনার শান্তছন্দে ঝড় উঠবে, কল্যাণের বুলি আওড়াতে আওড়াতে অকল্যাণ এসে ঢুকবে চোরা দরজা দিয়ে। শান্তির ছদ্মবেশে আসবে অশান্তি। সর্বনাশা অশুভ বুদ্ধির মদে মাতাল একটা শক্তি তছনছ করতে থাকবে চিরায়ত মূল্যবোধগুলি। তছনছ করতে থাকবে শ্রদ্ধা সম্মান আশ্বাস বিশ্বাস ভালবাসা।
সরোজাক্ষ এখন কী করবেন?
পদত্যাগ? না আবার মাথা হেঁট করে ফিরে গিয়ে বিনম্র দাসত্ব?
হ্যাঁ, পদত্যাগের প্রশ্নও আসছে।
এ শুধু কয়েকটা বাজে ছেলের ঔদ্ধত্যই নয়, এর পিছনে যেন রয়েছে সরোজাক্ষদের অসহায়তার ছবি। এ যেন দিন ফুরোনোর নোটিশ। যেন অদৃশ্য দেয়ালে দেয়াল-লিপি লেখা হচ্ছে, নীতি রত্নমালার মালা পরিয়ে পরিয়ে আমাদের সাজিয়ে রেখে এযাবৎকাল অনেক সুবিধে নিয়েছ তোমরা, বিনা দাবিতে দখল করে বসে আছ শ্রদ্ধা সম্মানের আসন, আর চলবে না ওসব কৌশল। আমরা শুধু পৃথিবীতে তোমাদের চেয়ে কিছুদিন পরে এসেছি বলেই তোমাদের চরণ পুজো করে চলব, এমন বোকামির দিন শেষ হয়েছে। তোমাদের গড়া ওই মিথ্যে ভব্যতার খোলস খুলে ফেলে আমরা বন্য হব, বর্বর হব, আদিম মানবের সন্তানের রূপে ফিরে যাব। যেটা নির্ভেজাল, যেটা সত্য।
ওদের এই শেয়াল ডাকের মধ্যে, মোরগ ডাকের মধ্যে, সিটি দিয়ে ওঠার মধ্যে যেন সেই সংকল্পের আভাস রয়েছে। আর সে সংকল্পের পিছনে রয়েছে একটা প্রবল যুথশক্তি।