ও মানে তোমার বর?
তবে না তো কী।
বলবেই তো৷ নিজে তো সে আস্বাদ পেল না কখনও।
আহা, ও কক্ষনও ওরকম নয়।
ভাল। না হলেই ভাল। তুমি যখন অত শুচিবাই। তবে আমি তো কিছু দোষ দেখি না।
দোষ দেখো না?
ব্রজবালা যেন হঠাৎ ভয় পায়, বলে ওঠে, যতসব বাজে কথা। শুনতে চাই না। বলে দুড়দুড় করে পালায়।
দিবাকর একটা পরিতৃপ্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে।
ভয় পেয়েছে।
পাক। সেটাই দরকার।
ভয়ের কাছেই আকর্ষণ।
দিবাকর অপমানের শোধ নেবে।
দিবাকর নিশ্চিত জানে ব্রজবালা ওই ভয়-ভয় করা ভয়ংকর কথার লোভে সুযোগ সৃষ্টি করবে। নবীনকে ছুতো করে ভাগাবে।
গা ছমছমে নির্জনতায় এসে বসে বলবে, বলো তো শুনি তোমার কেলাসের মেয়েদের কথা। আমার তো বাপু বিশ্বাস হয় না, তোমার নিশ্চয় সব বানানো।
দিবাকর অবশ্যই বানাবে।
ব্রজবালা সেই বানানো গল্প গোগ্রাসে গিলবে, গোগ্রাসে বিশ্বাস করবে, আর আস্তে আস্তে জালে পড়বে। মাকড়সার জালে বন্দিনী পোকার মতো ছটফট করবে। কিন্তু বেরোতে পারবেনা। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আত্মসমর্পণ করবে।
আর হয়তো ভাববে, আমার আবার ভয়টা কী? বিধবা নই, কুমারী নই–
.
কিন্তু মীনাক্ষী?
তাকে কবে সম্পূর্ণ কবলিত করে ফেলতে পারবে দিবাকর?
সেটার প্রয়োজন আছে।
দিবাকর তার নিজ গণ্ডি থেকে উর্ধ্বে উঠতে চায়। প্রফেসর মৈত্রের মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে সেই চাওয়াটা রূপ পেতে পারে। আর ওই বিয়েটার জন্যেই কবলিত করার দরকার।
মেয়েগুলো ভারী বোকা হয়।
একটু এদিক ওদিকেই ভাবে আমার সব গেল, গেল আমার শুচিতা, আমার পবিত্রতা, আমার সততা।
অতএব বিয়ে ভিন্ন আর গতি নেই আমার। বিশেষ করে মীনাক্ষীর মতো ভীরু মেয়ে। ও যেই ভাববে আমার সব গেছে, তখনই ও ওর সেই আদর্শবাদী অধ্যাপক বাবার কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ে বিয়ের জন্যে আর্জি করবে। দিবাকরকে কিছু করতে হবে না।
দিবাকর সেই ভরসাতেই আছে।
দিবাকর তাই কড়া কড়া বিদেশি নভেল পড়ে বোলচাল মুখস্থ করে রাখে যাতে মীনাক্ষীকে বিধ্বস্ত করে ফেলা যায়।
ঘরে এসে দিবাকর আবার চৌকিতে বসল, দেখল বালিশের তলায় একটা পোস্টকার্ড গোঁজা।
তার মানে এসেছে কোনও সময়, নবীনবাবু অনুগ্রহ করে রেখে দিয়েছেন।
দিবাকরের তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, হয়তো তার অনুপস্থিতিতে আসা চিঠিগুলো ফেলে দেয় নবীন। অবশ্য চিঠি কোথা থেকে আসবে সেটা জানা নেই দিবাকরের।
ভাল চিঠি। প্রত্যাশার চিঠি!
মাঝে মাঝে যা আসে সে তো ওই কদর্য অক্ষরে রচিত পোস্টকার্ড মাত্র। ওটাকে যত্ন করে রেখে না দিলেও ক্ষতি ছিল না। ওতে যে কী লেখা আছে দিবাকরের জানাই আছে। চিঠি দিবাকরের দাদার লেখা–
কল্যাণবরেষু
দিবাকর, পরে সবিশেষ জানাই বাটিস্থ সব কুশল। তবে মাতাঠাকুরাণী বাতের বেদনায় বিশেষ কাতর এবং মধু ও গোপাল পেটের রোগে ভুগিতেছে, তৎসহ জ্বর। প্রভাকরও কয়েকদিন যাবৎ আমাশায় কষ্ট পাইতেছে। তা ছাড়া তোমার বড় বউঠাকরুণও কার্বঞ্চল হইয়া প্রায় শয্যাগত। এইসব কারণে আমারও শরীর ভাল যাইতেছে না।
বাটিস্থ সব কুশল-এর পর এতগুলি ফিরিস্তি দাখিল করে দাদা অতঃপর শুরু করবে ঝড়ে একটি আমগাছ পড়িয়া গিয়াছে। বুধির একটি বকনা বাছুর নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বাঁশবাগান হইতে কে বা কাহারা বাঁশ কাটিয়া লইয়াছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাপর শেষ কথা তোমার কবে একজামিন শেষ হইবে? তোমার আসার আশায় দিন গুনিতেছি, তুমি আসিয়া পড়িলেই সব সুসার হইবে শ্রীভগবানের নিকট এই প্রার্থনা। ইতি–
নিত্য আঃ—-
তোমার বড়দাদা
এই চিঠি।
পর পর সাতখানা চিঠি সাজিয়ে রাখলে মনে হবে একই চিঠির কার্বন কপি। শুধুমাত্র কখনও আমগাছের বদলে জামগাছ, কখনও বুধির বদলে মঙ্গলা, অথবা বকনার বদলে এঁড়ে।
তা ছাড়া সব এক।
প্রবৃত্তি হয় না হাত বাড়িয়ে হাতে নিতে। প্রবৃত্তি হয় না পড়তে। তাই দিবাকর ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে একবার তাকিয়ে দেখে মাত্র।
আশ্চর্য, দিবাকর সম্বন্ধে কী ধারণা ওদের! দিবাকর লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি গিয়ে দাঁড়ালেই ওদের ছেলের পেটের অসুখ, মায়ের বাত, ভাজের ফোঁড়া ইত্যাদি সব সেরে যাবে, আর হবে না। পড়শিরা বাঁশ কেটে নেবে না। ঝড়ে আর গাছ পড়বে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
থাকো ভুয়ো এই আশা নিয়ে।
দিবাকর আর যাচ্ছে না। দিবাকর তোমাদের আত্মীয় বলতে লজ্জা পায়।
.
সরোজাক্ষ তাঁর সংসারের মাথায় এক ঘা লাঠি বসিয়ে দিলেন। সরোজাক্ষ তাঁর চাকরিতে ইস্তফা দিলেন।
প্রথম জীবনে যখন সরোজাক্ষ তাঁর জীবিকা বেছে নিয়েছিলেন, তখন কেন যেন তাঁর মনে হয়েছিল এটা ঠিক চাকরি নয়। এই অবাস্তব ভুল ধারণাটি অবশ্যই সরোজাক্ষর নিজস্ব মানসিক গঠনের ফসল, তবে সেই ভুল ধারণাটি সমূলে উৎপাটিত হবার তেমন কোনও কারণ ঘটেনি। অতএব সেই ভুলের রসটাই কোন অলক্ষ্যে থেকে সরোজাক্ষকে সঞ্জীবিত রেখেছিল।
কিন্তু সরোজাক্ষর এই বিপ্লবাত্মক কর্মই ভুলটা সমূলে উৎপাটন করল। সরোজাক্ষর কানের কাছে এখন অবিরত এই ধ্বনি, চাকরি ছেড়ে দিলে?চাকরিটা ছেড়ে দিলেন?–আজকালকার দিনে যদি এত তুচ্ছ ব্যাপারে চাকরি ছাড়তে হয়, তা হলে তো
যারা হিতৈষী, তারা এ প্রশ্নও করল–এই বয়েসে কোথায় তুমি কমপিটিশনে নামতে যাবে, ইয়ং গ্রুপের সঙ্গে? কথায় কথায় এখন মেয়েছেলেরা ডি ফিল, ডি এসপি, পি-আর এস হচ্ছে।