নবীনের সঙ্গে এইটুকু পার্থক্য দিবাকরের, নবীনের থেকে এইটুকু খাতির, জলখাবারটা ঘরে দিয়ে যায়। রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে আবেদন করতে হয় না।
তবু ওই থালাটা দেখলেই যেন গা জ্বালা করে। কিন্তু ফেলে দেওয়ার সামর্থ্যও নেই। খিদের সময় অযাচিত পেয়ে যাওয়া গরম রুটির মূল্যই কি কম?
দেশের বাড়িতে এই বস্তুটাও তো দুর্লভ ছিল। খাবে খাও, মুড়ি চিড়ে খাও।
এখন আর দেশের বাড়িতে গিয়েও ভাল লাগে না দিবাকরের! এই কলকাতার মোহমদ নেশাচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে। থাক দৈন্য, হোক অপমানের ভাত, তবু তো জুটছে এই মদ।
কলকাতার আকাশে বাতাসে, প্রতিটি ধূলিকণায় মদিরাস্বাদ।
তাই যারা বছরের পর বছর ফুটপাথে পড়ে থাকে, স্টেশনের প্লাটফর্মে জন্ম মৃত্যু বিয়ের লীলায় লীলায়িত হয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, যারা মানুষের চেহারা নিয়ে জানোয়ারের জীবনে নিমজ্জিত থাকতে বাধ্য হয়, তারাও পারে না কলকাতাকে ছেড়ে যেতে।
কলকাতা তার অক্টোপাশের বাহুতে বেঁধে রেখেছে সবাইকে।
দিবাকরও সেই বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছে।
দিবাকরের দাদারা বলেছিল, একটা পাশ করেছ, আর দুটো পাশ করে এসে গাঁয়ের ইস্কুলে মাস্টারি করো, নিজেরও ভাল গাঁয়েরও ভাল।
কিন্তু দিবাকর জানে গ্রামের জীবনে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয় তার।
দিবাকর এই চার বছরেই কলকাতার রসে জারিত হয়ে গেছে। দিবাকর কলকাত্তাইদের সঙ্গে তাল দেবার চেষ্টায় এত জোরে দৌড় দিয়েছে যে, তাদের ছাড়িয়ে গেছে।
দিবাকর তাই তার নিগ্রো নিগ্রো চেহারা নিয়েও অধ্যাপকের মেয়ের চোখে হিরো।
.
চেহারাটার ওই বিশেষণ স্পষ্ট করে কানে এল।
খাওয়ার শেষে বেগুন ভাজার খোসাটাও মুখে পুরে তাড়াতাড়ি উঠোনের কলে জল খেতে যাচ্ছিল দিবাকর, (না, জলের গ্লাস দিয়ে যায় না ঠাকুর) দেখল সিঁড়ি দিয়ে জামাই নামছে। পিছু পিছু ব্রজবালা।
ব্রজবালার ধরন দেখে মনে হচ্ছে না সেও চলে যাবে। মনে হচ্ছে এবার থাকতে এসেছে। অতএব বরকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বিদুষী নয় বলে কি আপ-টু-ডেট হতে পারে না?
গদগদ হাসিতে বিগলিত হয়ে নামছে সিঁড়ি দিয়ে।
জল খাওয়া হল না, চট করে গলির দিকের প্যাসেজে ঢুকে পড়ল দিবাকর। আর সেই সময় পিছনে পটকা ফাটল।
কাফ্রি কাফ্রি দেখতে ওই ছোকরাটি তোমাদের কে বলল তো?
কাফ্রি কাফ্রি? ব্রজবালা ভুরু কুঁচকে বলে, দিবুদার কথা বলছ নাকি? ও মাগো, জানো তোমার ডবল বিদ্বান উনি।
তাই নাকি? আহা!
গুড়ের কারবারের ভবিষ্যৎ মালিক কণ্ঠে গুড়ের প্রলেপ বুলিয়ে বলে, তবে তো তোমার বাবার উচিত নয় ওঁকে চাকরের ঘরে থাকতে দেওয়া! যথাযোগ্য সম্মানে–
বাকি কথা শোনা গেল না। উঠোন পার হয়ে বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল কম্পাউন্ডে। যেখানে গুড়ের কারবারির প্রকাণ্ড গাড়িখানা অপেক্ষা করছে।
জ্বলতে জ্বলতে ঘরে ফিরে এল দিবাকর জল খেতে ভুলে। আর সেই মুহূর্তে তার আগুনের ঢেলার মতো চোখ দুটোয় জ্বলে উঠল একটা রূঢ় সংকল্পের শিখা।
একটা নির্বোধ মেয়েকে নষ্ট করতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়?
কিছু না কিছু না।
বিবাহিতা?
পতিব্রতা সতী?
ফোঃ
ওসব কথাগুলোর কোনও মূল্য আছে নাকি?
বরং বিবাহিতাদের সাহস বেশি। দিবাকরের সে অভিজ্ঞতা আছে। স্কুলের পড়া সাঙ্গ করে আসবার আগেই সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছে দিবাকর। রাঙাপিসির মেয়ে চামেলিদির কাছ থেকে। অবশ্য বয়েসটা তার তখন নিতান্ত স্কুল-জনোচিত ছিল না।
চামেলিদির শ্বশুরবাড়িতে জ্বালা, তাই চামেলিদি বাপের বাড়িতে বসে থাকে। বর আসে সপ্তাহে সপ্তাহে।
কিন্তু চামেলিদির ওই মুষ্টিভিক্ষায় পেট ভরে না। তাই চামেলিদি উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়ায়। আর হেসে হেসে বলে, বিধবা নই, আইবুড়ো নই, ভয়টা কী?
অতএব বুঝতে বাকি থাকেনি দিবাকরের, ভয়ের বাসাটা আসলে কোথায়?
দিবাকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
দিবাকর তার সেই চামেলিদিকে দিয়ে সব মেয়েকে বিচার করছে।
দিবাকর ফিরতি মুখে পথ আগলায়, বড়লোকের বাড়ি বিয়ে হয়ে ব্রজবালা যে আর গরিবদের দেখতেই পাও না!
ব্রজবালা হঠাৎ এই আক্রমণে থতমত খায়, অপ্রস্তুত গলায় বলে, বাঃ, দেখতে পাব না কেন?
কই আর পাও? আসো যাও, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, তুমি তো ফিরেও চাও না।
আমি তো বেড়িয়েই চলে যাই, এসে থাকতে পাই না। এবারেই কিছুদিন
ব্রজবালা একটু রহস্যময় কটাক্ষ করে।
অর্থাৎ এবারে ব্যাপার আলাদা। এবারে কিছুদিন থাকবার অধিকার নিয়ে এসেছে।
দিবাকর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, নবীন নেই ধারেকাছে, কেউই নেই। চট করে ব্রজবালার গালটায় একটা টোকা দিয়ে নিচু গলায় বলে ওঠে,তাই নাকি? নতুন খবর?
ব্রজবালা রেগে ওঠে না।
ব্রজবালা লাল লাল মুখে বলে, আঃ অসভ্য!
দিবাকর একটা বেপরোয়া হাসি হেসে বলে, এইটুকুতেই অসভ্য? উঃ কী শুচিবাই! ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে যা চালাই দেখলে কী যে বলতে তুমি!
ব্রজবালা মাটির সঙ্গে আটকে যায়। ব্রজবালা বিস্ফারিত চোখে বলে, তোমাদের কেলাসে মেয়েমানুষও আছে নাকি?
তা নেই?
তাদের সঙ্গে তুমি এইসব ইয়ার্কি করো?
এইসব? দিবাকর তাচ্ছিল্যের গলায় বলে,আরও কত সব।
ধ্যেৎ।
ধ্যেৎ তো ধ্যেৎ।
এই দিবুদা সত্যি?
সত্যি না তো কি মিথ্যে বলছি? বিশ্বাস করো না করো তোমার ইচ্ছে। ব্র
জবালা হঠাৎ সতেজে বলে, ওইজন্যেই ও বলে লেখাপড়া শিখলে মেয়েমানুষ জাহান্নমে যায়।