মামিই দয়ার গলায় বলেছিলেন, তা ও তো তোমার, ওপরতলায় ওঠবার বায়না করছে না গো, নবীনের ঘরের একপাশে একখানা চৌকি পেতে পড়ে থাকবে। থাকার অভাবে গরিবের ছেলের নেকাপড়াটা হবে না!
প্রকাশ মণ্ডল বেজার গলায় বলেছিলেন,আত্মীয় সম্পর্কটা হচ্ছে বিষধর সর্পের মতো বুঝলে? দুধকলা দিয়ে পুষেছ কি মরেছ।
মামি আরও দয়ার গলায় বলেছিলেন,দুধকলার বায়না আবার কে করছে গো? সাপ্টা হেঁসেলের দুটো ডালভাত গুড়-রুটি খাবে, নিজের দিন কিনে নেবে, হয়ে গেল ব্যস। না না, তুমি অমত কোরো না, তোমার ঘরে মা-লক্ষ্মী হেলাফেলা। একটা পেট বই তো নয়।
সেদিন সেই বহু আড়ম্বরপূর্ণ ঘরে পালঙ্কোপবিষ্টা অষ্টালঙ্কারভূষিতা এই মহিলাটিকে দেবীসদৃশ মনে হয়েছিল দিবাকরের, কারণ দিবাকর তখন ভয়ংকর একটা উচ্চাশা নিয়ে দেশ থেকে চলে এসেছিল সদ্য স্কুল ফাইনাল পাশ করে। হোস্টেলে থেকে পড়বে এমন সামর্থ্য নেই। দাদারা বিরক্তচিত্তে মাত্র পড়ার খরচাটা পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তা মামির করুণায় বাকিটা হয়ে গেল, কোথা থেকে যেন একটা পায়া নড়বড়ে চৌকি এসে গেল নবীনের ঘরে, মামির খাস ঝি অবলা এসে দাঁড়িয়ে ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল কোন দিকে নবীনের জিনিসপত্র থাকবে, কোন দিকে দিবাকরের।
উনি নেকাপড়া করবে, জাঁল্লার দিকটা ওনার থাক- এ বিবেচনা প্রকাশ করেছিল অবলা। কিন্তু নবীনের কাঠকবুল প্রতিজ্ঞা জানলার ধারের অধিকার ছাড়বে না। কাজেই দেয়ালের দিকেই দিবাকর কায়েম হল।
বরাদ্দ হল সাপ্টা হেঁসেলের ডালভাত গুড়টি। যে হেঁসেলটার অধীনস্থ প্রজা হচ্ছে প্রকাশ মণ্ডলের দোকানের কর্মচারীকুলনবীন, বিষ্ণু প্রমুখ। অবলা খাস ঝি। অবলা এদের দলে নয়। কর্তা-গিন্নির হেঁসেলের তলানিতেই তার ভাল ব্যবস্থা হয়ে যায়।
তখন মামার একটা বছর চোদ্দর মেয়ে ছিল, যার নাম ব্রজবালা। মেয়েটা সম্পর্ক সূত্র শুনে দিবাকরকে দাদা বলতে শুরু করেছিল এবং বিশেষ একটু নেজরের বশে লুকিয়ে চুরিয়ে দিবাকরকে দুধটা মিষ্টিটা মাছটা ডিমটা সাপ্লাই করতে শুরু করেছিল, কিন্তু নবীনের বিশ্বাসঘাতকতায় লুকোচুরিটা প্রকাশ পেয়ে গেল। ঘরের ভাগ দিতে বাধ্য হওয়া পর্যন্ত নবীন দিবাকরের দিকে আক্রোশের দৃষ্টি ব্যতীত কদাচ সমীহর দৃষ্টিতে তাকায় না, এহেন সুবর্ণ সুযোগটা ছাড়ল না।
ফলস্বরূপ ব্রজবালার নীচে নামা বন্ধ হল, দিবাকরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হল। মরুভূমির ওয়েসিসটুকু শুকোল।
তারপর তো ব্রজবালার বিয়েই হয়ে গেল।
এখন ব্রজবালা শ্বশুরবাড়ি থেকে আসে যায় সোনার ঝলক দিয়ে, কারণ তার শ্বশুর গুড়ের কারবারে অনেক লক্ষপতি। সেই সোনার ঝলসানিতে ব্রজবালারও বোধ করি মনে থাকে না দিবাকর নামে কেউ একটা থাকে এ বাড়িতে। দিবাকর রাগে ফোঁসে।
তবু মাথার উপর ছাদ।
কোলের গোড়ায় বাড়া ভাতের থালা।
তাই দিবাকর এখানেই পড়ে আছে।
পড়ে থাকার আর একটা সুবিধে, বাইরে থেকে এসে ঢোকে তো মস্ত দেউড়িটা ঠেলে। সাবান কেচে ইস্ত্রি করে বহু কষ্টে ফিটফাট করা পোশাকটি পরে যখন বেরোয় কলেজের বই খাতা নিয়ে, তখন তো বেরোয় সেই দেউড়িটা খুলে।
লোককে তো বলা যায় বিরাট মামার আদুরে ভাগ্নে। সেটাই কি কম পাওয়া। সেই আদরের চেহারাটা তো বন্ধুসমাজ দেখতে আসে না।
বাড়িতে কাউকে ডাকতে পারে না দিবাকর, কারণ মামা ছাত্রজীবনে আড্ডা দেওয়া পছন্দ করেন না।
এই বালির দুর্গে বাস দিবাকরের।
তাই ভিতরে তার এত দাহ।
তাই তার প্রেয়সী যখন নিজের পাথরের দুর্গে গিয়ে ঢোকে, আক্রোশের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সে।
সকালবেলা ছেড়ে রেখে যাওয়া লুঙ্গিটা পরে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে আর এক আক্রোশের মনোভাব নিয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখছিল দিবাকর।
চকমিলানো ছাঁচের বাড়ি, নীচতলা থেকে ওপরতলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা যায়। থাকলে দেখতে পাওয়া যায় চড়া পাওয়ারের আলো জ্বালা, দেয়ালে রং করা, কেমন শনশন করে বিদ্যুৎ পাখা ঘুরে ঘুরে বাতাসের দাক্ষিণ্য বিতরণ করছে।
দোতলায়, তিনতলায়।
দোতলাটা মামা-মামির মন্দির, তিনতলাটা মামির ভাই-ভাজের। সমান রাজকীয়। অথচ ওরাও আশ্রিত–ভাবল দিবাকর। অনেক বাড়তি জায়গা আছে উপরতলায়। ওদের ঘরের একাংশে গিয়ে বসলে আলাদা করে বিদ্যুৎ খরচ হবে এমন নয়।
তবু দিবাকরকে চাকরের ঘরের কোণে বসে ভাঙা হাতপাখায় বাতাস খেতে হয়!
দিবাকর তবে অন্নদাতা আর আশ্রয়দাতা বলে কী করে কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হবে ওই প্রকাশ মণ্ডলের প্রতি?
দিবাকর কেন সর্বদা চিন্তা করবে না কী করে লোকটার অনিষ্ট সাধন করা যায়?
চিন্তা করে, কিন্তু সুযোগ নেই।
নির্বোধ ব্রজবালাটার ওপর দিয়ে সে আক্রোশ মিটিয়ে নেবার বাসনা ছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। ওই শয়তান নবীন, সর্বদা শ্যেনদৃষ্টি মেলে বসে থেকেছে, সুযোগের সুযোগ আসেনি।
তারপর তো ব্রজবালা ব্রজধামে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল।
আজ নাকি এসেছে বরের সঙ্গে। প্রকাণ্ড গাড়ি চড়ে।
গাড়িটাই গেট থেকে সংবাদ বহন করছে। দেখলে বিষ ওঠে।
জামাইটা নাকি একটা পাশ করা। সেই গৌরবে গরবিনী মামি এমন ভাব করেন যেন জামাতা না দেবতা!
এই পৃথিবীতে থাকতে হয় দিবাকরকে।
বামুন ঠাকুর একটা পিতলের রেকাবি করে জলখাবার রেখে গেল। রুটি, একটুকরো বেগুন ভাজা, খানিকটা গুড়।