অধ্যাপক প্রসঙ্গ স্তিমিত হয়ে গেলে ওরা হয়তো মডার্ন কবিতা বা মডার্ন আর্ট নিয়ে বিতর্ক সভা বসাবে এবং বোলচাল শুনে মনে হবে প্রত্যেকেই এরা এই মডার্ন রহস্যে ওয়াকিবহাল। ওদের চলনে বলনে সেই মাতব্বরি, ওদের ভাষার ছটায় সেই তীব্রতা।
কিন্তু এরাই কি সব?
নাঃ, এরাই সর নয়।
হয়তো এরা নিতান্তই সংখ্যালঘু।
তবু এরাই যেন আজ যুবসমাজের প্রতিনিধির ভূমিকা নিয়ে আসরে নেমেছে, এদের কণ্ঠ সোচ্চার। সেই উচ্চ চিৎকারে সংস্কৃতির ক্ষীণকণ্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে। আশঙ্কা হচ্ছে ক্রমশ এরাই বুঝি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
কারণ তীব্রতার একটা আকর্ষণ আছে, বলমত্ততার একটা প্রভাব আছে। আর–ভাল ছেলে নামের ধিক্কার বাণীটা বড় ভয়ংকর। তাতে ভাল ছেলেদের লজ্জায় দিশেহারা করে কোথায় না কোথায় নিয়ে যেতে পারে।
.
দিবাকর ভাল ছেলে নয়, দিবাকর বরং বন্যতার প্রতিমূর্তি। তাই দিবাকরের প্রেম, ভালবাসা, আসক্তি উগ্ৰ অসহিষ্ণু। তার মধ্যে স্নেহের স্বাদ নেই। তাই মীনাক্ষী নিজের বাড়ির দরজার মধ্যে ঢুকে গেলে। দিবাকর খানিকক্ষণ হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন মীনাক্ষীর ওই নিশ্চিন্ত আশ্রয়টুকু, ওই আরাম-আয়েস সুখ-স্বস্তিভরা গৃহকোণের অধিকারটুকু ছিঁড়েকুটে তছনছ করে দিতে পারলে ওর জ্বালা মেটে।
কারণ দিবাকরের ওসব নেই।
দিবাকর জানে এখান থেকে মোচড় খেয়ে ঠিকরে গিয়ে একটা বাসে চেপে পড়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যে দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে ও, সেখানে ওর ভূমিকা দরজায় দাঁড়ানোরই। যে ঘরে গিয়ে ঢুকবে সেখানে দিবাকরের কোনও অধিকার নেই।
নিতান্তই গ্রাম-সম্পর্কের এক মামার অবহেলার আশ্রয়ে বাস দিবাকরের। দিবাকর জানে এখন গিয়ে সেই প্রাসাদতুল্য বাড়িটার নীচতলায় একখানা অন্ধকার-অন্ধকার ছোট্ট ঘরে গিয়ে ঢুকতে হবে তাকে। যে ঘরটার অর্ধাংশ দখল করে থাকে বাড়ির ঝাড়মোছকরা চাকর নবীন।
ঘরটা রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর আর খুঁটে কয়লার ঘরের মাঝামাঝি কোনও একখানে। বাইরের আলো-হাওয়ার প্রবেশপথ বলতে একটিমাত্র সংকীর্ণ জানলা আছে গলিপথের দিকে। নবীনের শোয়ার চৌকিটা সেই জানলার নীচে। অতএব দিবাকরের ঠাঁই গুমোট দেয়ালের দিকে।
দিবাকরের সেই চৌকির গা ঘেঁষেই দেয়ালের গায়ে টানা লম্বা একটা দড়ি টাঙানো, যেমন ও দেয়ালে নবীনের। নবীনের দড়িতে নবীনের জামা পায়জামা ধুতি শার্ট গেঞ্জি গামছা, দিবাকরের দড়িতে দিবাকরের প্যান্ট বুশশার্ট লুঙ্গি তোয়ালে গেঞ্জি।
নবীনের মাথার কাছের দেয়াল-আলমারিতে নবীনের গোলাপ ফুল আঁকা টিনের সুটকেস, ক্যালেন্ডার থেকে সংগৃহীত নানা দেবদেবী ও সিনেমা স্টারের ছবি, বড় সাইজের একখানি আরশি, প্লাস্টিকের চিরুনি, কুন্তল বাহার তেলের শিশি, মলয় সাবান, রেণু পাউডার, আর গোছভর্তি দাঁতন কাঠি।
দিবাকরের মাথার কাছের দেয়াল-আলমারিতে দিবাকরের সস্তা ধরনের ঢাউশমার্কা নকল চামড়ার সুটকেসটা ধরে না বলে, সুটকেসটা ওর চৌকির নীচে ঢোকানো আছে। দিবাকর সেটাকে সর্বদা তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখে এবং যখন-তখন তালা খুলে উলটেপালটে সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে হিসেব মিলোতে বসে সব ঠিক আছে না চুরি গেছে।
আলমারির তাকে দিবাকরের নবীনের থেকেও সস্তামাকা আরশি চিরুনি তেল সাবান মাজন শেভিংসেট। আর আছে পাঠ্যপুস্তক ও খাতা কলম, পার্থক্য শুধু এই।
দিবাকর এখন গিয়ে পরনের শার্ট ট্রাউজার সাবধানে ভাঁজ করে দড়ির আলনায় তুলে রেখে লুঙ্গিটা জড়িয়ে বেজার মুখে নিজের চিরশ্যা পাতা চৌকিটায় গিয়ে বসে কিছুক্ষণ হাতপাখা চালিয়ে গায়ের ঘাম শুকিয়ে নিয়ে তারপর উঠোনের ধারের চৌবাচ্চাটার কাছে গিয়ে উঁকি মারবে। যদি দেখে কিছু কিঞ্চিৎ জল আছে, মুখের পেশিগুলো তার একটু ছড়িয়ে পড়বে। উলটোটা হলে সেই পেশিগুলো আরও গুটিয়ে যাবে, মুখটা ঝামা ইটের চেহারা নেবে–মগ ঠুকে ঠুকে কোনওরকমে একটু স্নান সেরে যখন ঘরে এসে কুচি কুচি করে ছাঁটা চুলগুলো ঝেড়ে আঁচড়াবে দিবাকর, তখনও সেই চেহারাটাই বজায় থেকে যাবে। ঝামা ইটের চেহারা।
বরং আরও বেড়েই যাবে মুখের সেই ঝামাত্ব, দোতলা তিনতলার আলো-ঝলমলে ঘর-বারান্দাগুলোর চেহারা স্মরণ করে।
ওই ওপরতলাগুলোকে চোখে দেখবার সুযোগ তার মাঝে মাঝে হয়, মামি কখনও কখনও কোনও কূট ফরমাশে ডাকেন। বলেন, নবীনের দ্বারা এসব তো হবে না, বিষ্ণুটাও তেমনি বুন্ধু। তুমি এটা করো দিকি।
কদাচ তুমি ছাড়া তুই বলেন না মামি, নিকটতম স্নেহ সম্বোধনে আত্মীয় সম্পর্কটাকে প্রতিষ্ঠিত করবার ইচ্ছে তাঁর নেই বলেই মনে হয়।
দিবাকর মামির ঘরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, মামি হয়তো কিছু কেনবার জন্যে টাকা দেন, হয়তো কোনও একটা ঠিকানা আর বাসভাড়া। কোনও খবর আনতে হবে, কি কোনও খবর পৌঁছতে হবে।
হয়তো তেমন আদেশ দিবাকরের পরীক্ষার দিনও আসতে পারে। দিবাকরের সাহস হয় না সে কথা উল্লেখ করবার। কারণ এখানেই ওই নবীনের ঘরের অর্ধাংশের আশ্রয়টুকু ও দুবেলার নিশ্চিত অন্নের নিশ্চিন্ততাটুকু এই মামিরই বদান্যতায়।
প্রথম যখন দিবাকর দেশ থেকে এসে দূরতম মামা সম্পর্কের ভরসাটুকু সম্বল করে এই বড় বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিল, মামা প্রকাশ মণ্ডল তো প্রায় সেই দরজা থেকেই বিতাড়িত করেছিলেন, এখানে জায়গা কোথায় বলে।