অতঃপর তর্ক উদ্দাম।
এভাবে কথা বলা নিজেদেরই সভ্যতা নষ্ট করা।
ও হো হো তাই নাকি? চুক চুক। এটা বাইবেলের কোন অধ্যায় ব্রাদার?
সে আপনারা যাই বলুন, আমি বলব, প্রফেসর মৈত্র সত্যিকার ভাল লোক।
ভাল লোক!ভাল শব্দটার ধাতুরূপ কী মাইরি? লোকটা একটা পেঁতি বুর্জোয়া, বুঝলেন? স্রেফ একটা পেঁতি বুর্জোয়া। আবার গাড়ি চড়ে কলেজে আসা হয়। মাইনে তো টুটু কোম্পানি, তাতে সংসার চালিয়ে গাড়ি চালানো যায়? হুঁ! অন্য আয় আছে বুঝলেন?
সেটা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু নিশ্চয় বলব পড়ানোর ব্যাপারে ওঁর তুল্য আর একজনও নেই। সবাই তো ফাঁকিবাজের রাজা। তাদের মুখ্য বিজনেস খাতা দেখা আর টিউশানি করা। ক্লাস নেওয়াটা গৌণ। সাইড বিজনেস।
কিন্তু প্রফেসর মৈত্রের
আরে বাবা ক্যাপাসিটি থাকলে তো? ওই পড়ানোটুকু পর্যন্তই ক্ষমতার সীমা।
তা আমাদের সেটাই দরকার।
হতে পারে। তবে একটু ভাল পড়ায় বলে ধরাকে সরা দেখবে? হাতে মাথা কাটবে? গেট আউট বলবে? অত কীসের? ব্যস, দিয়ে দেওয়া গেল একটু টাইট। আর বলতে হবে না কিছু। মাথাটি হেঁট করে এসো, মাথাটি হেঁট করে চলে যাও, ব্যস! ওসব মধ্যযুগীয় জমিদারের মনোভাব নিয়ে বাঘের বাচ্চা চরাতে আসা চলবে না বাছাধন। স্টুডেন্টরা তোমার খাস তালুকের প্রজা নয়।
অপর পক্ষে প্রতিবাদ ওঠে, এটা আপনাদের বাড়াবাড়ি হচ্ছে। উনি মোটেই ও ধরনের নন।
কী হল মশাই? মৈত্র কি আপনাদের উকিল রেখেছে? উনি কী ধরনের, আপনার থেকে আমি ভাল জানি। একদিন ও এই শিবেন্দুর হাত থেকে একটা বই নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল তা জানেন?
ছিড়ে ফেলেছিলেন? বই? কী বই?
নামটা ঘোড়ার ডিমের মনে নেই। একটু ইয়ের ব্যাপার আর কি সাদা বাংলায় বলি মশাই একখানি কড়া সেক্সের বই। বহু চেষ্টায় জোগাড় করেছিল বেচারা
তা সেখানি ক্লাসে এনে প্রফেসরের নাকের সামনে না পড়লে চলত না?
হঠাৎ ও পক্ষ থেকে সমবেত একটি হাস্যধ্বনি ওঠে। হাস্যরোলই।
সদাচার সমিতিতে নাম লেখান গে মশাই, সেটাই আপনাদের উপযুক্ত জায়গা
ঠাট্টা করুন। তবু বলব এভাবে শিক্ষককে অপমান করার মধ্যে নিজেদেরও কোনও মর্যাদা নেই। আমরা যদি আমাদের মা বাপকে অপমান করতে বসি, সেটা আমাদেরই অসম্মানকর।
কথাটা সম্পূর্ণ শেষ হয় না-হয়, একটা হুক্কাহুয়া ধ্বনিতে চাপা পড়ে যায়। এরা তুলছে ওই শেয়ালডাক। এরা হেসে টেবিল চাপড়ে বলছে-আহা হা চুকচুক, দেশে কোথাও ধর্মযাজকের পোস্ট খালি নেই? চলে যান, চলে যান। সেটাই উপযুক্ত ক্ষেত্র আপনাদের।
তারপর নিজেদের বাহাদুরিতে উল্লসিত দল নানা জানোয়ারের ডাক ডাকতে শুরু করে, প্রতিপক্ষ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তা ছাড়া আর কী করতে পারে? চিরদিনই বর্বরতার দাপটে সভ্যতা চাপা পড়ে যায়, চিৎকারের নীচে মৃদুতা।
ওদের চলে যাওয়া দেখে এরা আরও খানিক হইহই করে উঠল, তারপর আবার শুরু করল, আজ আর কলেজে আসেনি! হ্যাঁ, হ্যাঁ বোধহয় অপমানের জ্বালায় বাসায় গিয়ে মরে আছে। কদিন না এসে থাকবে জাদু? এখানেই যে ভাত জল।…বলে কিনা কাজটা ভাল হয়নি। ইঃ, খাশা হয়েছে। বেশ হয়েছে। উত্তম হয়েছে। ওই একজনের টাইটে আরও সবাই সায়েস্তা হয়ে যাবে।…হুঁ হুঁ, এ হচ্ছে বাবা সায়েস্তা খাঁর আমল।
আরও কিছু অর্থহীন অভব্য উক্তির প্রতিযোগিতা চালাতে থাকে ওরা। যেন যে যত নোংরা আর অমার্জিত কথা বলতে পারবে সে তত বাহাদুর। তার সঙ্গে অনুপান অশ্লীল হাসি।
অথচ এরা একটি বিশিষ্ট কলেজের ছাত্র, লেখাপড়ায় খারাপও নয় হয়তো, যখন শিল্প, সাহিত্য, সমাজনীতি বা রাজনীতি নিয়ে কথা বলে, মনে করা যেতে পারে বুদ্ধিমান চিন্তাশীল সর্বজ্ঞ।
কিন্তু কোনও একটা উপলক্ষে যদি একবার খুলে পড়ে উপরের খোলস, ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে আদিম বর্বরতা। যে বর্বরতা শ্রদ্ধা সম্ভ্রম স্নেহ ভালবাসা রুচি আচরণ, সব কিছুকে নস্যাৎ করে দিয়ে একটা বন্য সুখে উল্লসিত হয়।
কে জানে, সত্যিই এদের ভিতরটা এইরকম অশালীন অপালিশ,না এটা শুধু যুগের ফ্যাশান। কোনও কিছুকে মূল্য দেব না এই ফ্যাশান নিয়ে এরা নিজেদেরকে নিরাবরণ করে উন্মত্ত নৃত্য করে।
ওরা ভাবছে ওরা খুব বাহাদুর, জানে না যুগ একথায় হাসে। জানে না ওরাই এ যুগের প্রধান বলি। যুগ ওদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, ওদের মধ্যে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শুভ তা নিঃশেষে নিষ্কাশিত করে দিয়ে ওদের সেই শুকনো চামড়াখানায় জয়ঢাক বাজাতে চাইছে।
যুগ ওদের দিয়ে নোংরা কথা বলাচ্ছে, নোংরা চিন্তা করাচ্ছে, ওদের চোখ থেকে সব রং কেড়ে নিচ্ছে, মন থেকে সব রস।
তাই ওরা নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, এইসব শব্দগুলোকে ওল্ড মডেল বলে হেসে ওঠে। প্রেম ভালবাসা এই শব্দগুলোকে ধিক্কার দেয়। গুরু এবং গুরুজনকে টাইট দিতে পারাটাকেই ওরা চরম আধুনিকতা ভাবে। ভাবে মানুষ নামের জীবটার যুগ-যুগান্তরের রুচির সভ্যতার আর সংস্কৃতির সাধনাকে মুছে ফেলে, তার কেবলমাত্র জৈবিক সত্তাটাকেই শেষকথা বলে ফতোয়া জারি করাটাই হচ্ছে আধুনিকতা।
চিরাচরিতকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টায় এরা চিরন্তন আচার আচারণকে উড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, আর ভাবে সেটাই আধুনিকতা। ওদের কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা এই। সাহস আর উদ্ধৃঙ্খলতা যে এক জিনিস নয়, সেটা ভেবে দেখে না।