ভাবে, তবু মাথার মধ্যে একটা আর্তস্বর অনবরত ধাক্কা দিতে থাকে, বাইরে আজ হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে এসেছি, এবার তোমাদের কাছেও তাই চাইছি, দয়া করে তুমি এ-ঘর থেকে যাও।
অর্থাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।
ধাক্কাটা তখন অনুভবে আসেনি।
তখন মীনাক্ষীর মনের সঙ্গে শরীরটাও শক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই শক্ত হয়ে যাওয়া শরীরটায় একটা। মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসছিল মীনাক্ষী, কিন্তু বেরিয়ে আসা হয়নি।
তার আগেই সরোজাক্ষর মাথাটা অসহায়ভাবে বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছিল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে ভেবেছিল মীনাক্ষী,–অথচ আমি দিবাকরের কথা তুলিনি। কিন্তু তুলব বলেই ঘরে ঢুকেছিলাম।
সারদার বয়েসটা যে নেহাত কম তা নয়, কিন্তু আকৃতি এবং প্রকৃতি দুজনেই যেন ওকে মাঝপথে কোনও একখানে বসিয়ে রেখে কোথায় সরে পড়েছে।
সারদাকে দেখলে তাই মনে হয় যেন একটি চটপটে ছটফটে খটখটে যুবক, আর সারদার কথা শুনলে মনে হয়, কৈশোর এখনও অতিক্রম করেনি।
ওষুধ নিয়ে যখন ফিরছিল সারদা, তখন তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হতে পারত দৌড়ের রেস দিচ্ছে। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক শান্ত হয়ে গেল। সন্তর্পণে সিঁড়িতে উঠতে লাগল জুতো খুলে পা টিপে টিপে।
নিতাই খাবার কথা জিজ্ঞেস করে ধমক খেয়েছে। বাড়ির কর্তা মুখের খাবার ফেলে বিছানা নিয়েছে, আর বাড়ির অন্য সদস্যরা খাবে, এর চাইতে নির্লজ্জতা আর কী হতে পারে জানা নেই সারদার। সেই নির্লজ্জতার প্রশ্ন নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ছিল নিতাই। অতএব ধমক খাবে, এটা স্বাভাবিক।
তবে ধমকটা উচ্চারিত হল খুব চাপা গলায়। খাওয়া? খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করছ? লজ্জা করল না? সব রান্না টান মেরে ফেলে দাও গে–।
এই বলে আবার উঠে যায় নিঃশব্দে, হাতের ওষুধগুলো নামিয়ে রাখে টেবিলে। যার সামনে বসে মীনাক্ষী নিদ্রায় গভীর, আর যেন অপরিচিত একটা মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল, অথচ আমি দিবাকরের কথা তুলিনি।…
ভেবেছিলাম আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলব। হল না। সরোজাক্ষ হঠাৎ শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন বলেই কি বলা হল না?
সরোজাক্ষ সুস্থ সবল হয়ে বসে শুনলেই কি বলা হত?
হত না।
অনুভব করল মীনাক্ষী। আর মনে মনে বলল, দিবাকর ঠিকই বলে, আমি ভীরু আমি ভীরু। কিন্তু আমাকে সাহসী হতে হবে।
.
কমনরুমে জোর আড্ডা চলছিল।
নাঃ ঠিক আড্ডা নয়, বরং বললে ঠিক হবে বিতর্ক। বিষয়বস্তু প্রফেসর মৈত্র।
গতকালকার ঘেরাও ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং উত্তেজনার ঝড় বইছে। ঘটনাটার প্রস্তুতিপর্বেই ছাত্রদের মধ্যে দুটো দল হয়ে গিয়েছিল, কাজেই এখন চলছে দুই শিবিরের বাকযুদ্ধ।
অবশ্য ছাত্রদের এই দলবিভেদটা যে কেবলমাত্র তাদের অধ্যাপকের লাঞ্ছনাকে ঘিরেই ঘটেছে তা নয়, এমনিতেই রাজনৈতিক মতবাদের পার্থক্যে তারা বহু শিবিরে বিভক্ত।
বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, বাম-দক্ষিণ পন্থী, দক্ষিণ বাম পন্থী এবং বাম-উগ্র বাম, দক্ষিণ-উগ্র দক্ষিণ, বামেতর দক্ষিণ বা দক্ষিণেতর বাম ইত্যাদি নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শাখায় বিচরণ তাদের।
তারা কেউ কারও সঙ্গে পানভোজন করে না, কেউ কারও সঙ্গে খেলাধুলা করে না এবং একে অপরের শুধু অস্পৃশ্যই নয়, ব্যঙ্গের পাত্র, করুণার পাত্র, অবজ্ঞার পাত্র।
আবার ওরই মধ্যে যারা বেশি বলবান গোষ্ঠী, তারা দুর্বল পক্ষকে ভয় দেখিয়ে দলভুক্ত করবার চেষ্টাতেও দ্বিধা করে না।
স্বাভাবিকই।
আমার মতবাদে যে আস্থাশীল নয়, সে আবার মানুষ নামের যোগ্য নাকি? এই তো মনোভাব মানুষের। অতএব হয় তাকে স্বমতে এনে মনুষ্য পদবাচ্য করে তুলব,নয় তাকে ঘৃণা করব, অবজ্ঞা করব, করুণা করব।
বন্ধুত্ব?
কদাচ না।
আমার দলে না ভিড়লে আবার বন্ধুত্ব কীসের? বন্ধুত্ব করব তুমি একটি সুন্দর হৃদয় ঐশ্বর্যের ঐশ্বর্যবান বলে? ধুত্তোরি রাবিশ! হৃদয় আবার একটা বস্তু নাকি? হৃদয়ে হৃদয়ে বন্ধুত্ব, ওসব হেঁদো কথায় আর বিশ্বাস করে না এ যুগ।
এ যুগ জানে বন্ধুত্ব সম্ভব কেবলমাত্র মতবাদে মতবাদে। বন্ধুত্ব সম্ভব শুধু একই শিবিরের ছায়ায়। সেখানে হৃদয় বস্তুটা হাস্যকর।
তা এরা সেই এক শিবিরেরই লোক–অসিত, দিলীপ, অনিল, কুমারেশ, বিমল, শিবেন্দু, অবনীশ, ইন্দ্রজিৎ, পরাশর এবং আরও অনেকে। সম্প্রতি প্রফেসর মৈত্রকে কেন্দ্র করে ওদের মধ্যেও দলবিভেদ ঘটে গেছে। আবার আর একটি শিবির বেড়ে গেছে।
এদের এক পক্ষ গতকালকার ঘটনায় লজ্জিত দুঃখিত মর্মাহত, অপর পক্ষ উল্লসিত, উচ্ছ্বসিত, বীরত্বে গর্বিত।
ছেলেবেলায় স্কুলে থাকাকালীন অবস্থাতে এ পদ্ধতি ছিল তাদের। কোনও এক ছেলের সঙ্গে কোনও এক ছেলের ঝগড়া হলেই চটপট দুটো দল গড়ে উঠত, যার নাম গ্যাঙ। একটা গ্যাঙ একটা ছেলেকে সমর্থন করত, অপর গ্যাঙ অপর ছেলেকে। বলা বাহুল্য কলহ অনলকে অতএব জইয়ে রাখত তারা নিজ নিজ দুষ্টুমির ইন্ধনে। যাদের মধ্যে বিবাদ, তারা পরস্পরে অনুতপ্ত হলেও, ঝগড়া মিটিয়ে নেবার উপায়টি আর থাকত না তাদের নিজের হাতে।
এখন এরা নিজেদেরকে আর গ্যাঙ নামে অভিহিত করে না বটে, তবে মনোভাবটার পরিবর্তন ঘটেনি।
পরিবেশ অন্য, সহপাঠীরা অন্য, কারণও অন্য, কিন্তু মনোভাব অপরিবর্তিত। তাই এক পক্ষ যখন বলে, কালকের কাজটা ভাল হয়নি, অপর পক্ষ তখন বলে, আরে রেখে দিন মশাই আপনাদের মেয়েলিপনা। ঠিক কাজ হয়েছে। মুখের মতো জুতো হয়েছে, কুকুরের উপযুক্ত মুগুর।… শা-কে যা টাইট দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে আর ট্যাঁ-ফোঁকরতে হবেনা। শা–ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি। এবার বুঝবেন বাছাধন, সাপের ল্যাজে পা দেওয়ার ফলটা কী!