কেন, বাবার সাধের ছাত্ররা। ঘেরাও করে ধরেছিল। ক্ষমাটি না চাইলে ওইখানেই গুম করে রেখে দিত।
বিজয়া এবার স্থির গলায় বলেন, এসব কথা কখন হল, কই উনি তো
আরে বাবা, নিজে মুখে কি আর বলবেন উনি?না, বলেন কিছু কখনও?–শুনলাম আমার শালার মুখে। তার শালীর ছেলে পড়ে ওখানে, সে এসে গল্প করে গেছে। করবেই তো, এমন একটা মজাদার গল্প! তবে কী আশ্চর্য যে সুমতি হয়েছিল, ক্ষমা চেয়েছিলেন, জেদ করলে ব্যাপার গুরুতর হয়ে উঠত।
বিজয়া ক্রুদ্ধগলায় বলেন, তা কারণটা কী ঘটল? খামোকা
কারণ আর কি!নীলাক্ষ অলস গলায় বলে, মধ্যযুগীয় জমিদারের মনোভাব। মনে করছেন ছাত্ররা সবাই ওঁর প্রজা, তাই মেজাজ দেখিয়ে বসেছেন। আরে বাবা, মেজাজ দেখাবার যুগ যে আর নেই, সেটা খেয়াল করবে তো?
যুগ থাকবেনা কেন, খুব আছে। বিজয়া ঝংকার দিয়ে বলে ওঠেন, যুগ-মাহাত্ম্যে মেজাজ দেখাবার অধিকারটা রাজা থেকে প্রজায় বর্তেছে এই যা! তা নইলে ঘরের বউ সন্ধে না হতেই ধেই ধেই করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, রাত দুপুরে বাড়ি ফিরছেন, ফিরে এসে পালঙ্কে অঙ্গ ঢেলে দাস-দাসীকে হুকুম করছেন, আর বুড়ো শাশুড়ি সংসার নিয়ে মরছে? যুগমাহাত্ম্যর গুণেই তরে যাচ্ছে এসব। বলতে গেলেই। মেজাজ
এবার দরজার কাছে আর একটি মূর্তির ছায়া পড়ে, এবং খুব শান্তগলার একটু কথা শোনা যায়। সংসারের জ্বালা কি সিঁড়ি ভেঙে তিনতলা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে মা?
বিজয়া ছটফটিয়ে ওঠেন এই শান্তকণ্ঠের দাহে। যদি গলা তুলে ঝগড়া করতে আসত তাঁর সঙ্গে, তা হলে যেন মর্যাদা বজায় থাকত তাঁর, তিনিও তার উপর গলা তুলে বিজয়িনী হতে পারতেন। কিন্তু এই শান্তভাষার যুদ্ধ যেন হাতিয়ার কেড়ে নেওয়া যুদ্ধ।
তাই যুদ্ধের অন্য পথ ধরলেন তিনি, কড়াগলায় বলে উঠলেন, হচ্ছিল মায়ে-ছেলেয় কথা। তুমি তার মধ্যে নাক গলাতে এলে কেন শুনি?
শুধু মায়ে-ছেলেয় কথা হলে অবশ্যই আসতাম না। ঘরের বউয়ের আচরণের কথা উঠল কি না—
বিজয়া হইচই করে তেড়ে ওঠেন, উঠবেই তো, একশোবার উঠবে। পাঁচঘণ্টা বেড়িয়ে এসে ঘরে ঢুকে অঙ্গ ঢাললে, শ্বশুর যে মরতে পড়েছে তা একবার তাকিয়েও দেখলে না। মুখ নেড়ে কথা বলতে লজ্জা করছে না তোমার?
শ্বশুরকে সুনন্দা ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, অসুস্থতার সংবাদে উদ্বিগ্ন হয়নি তা নয়। কিন্তু উদ্বেগ · প্রকাশের ধৃষ্টতা তার নেই, ধৃষ্টতা নেই শ্বশুরের শিয়রে গিয়ে বসবার। সরোজাক্ষর সামনে সাধ্যপক্ষে বেরোয় না আর সে। অর্থাৎ যতদিন থেকে মূর্তি বদলেছে তার।
কিন্তু এই মহিলাটিকে বরদাস্ত করা কঠিন। মানুষের মধ্যেকার কোমল বৃত্তিটুকুকে টেনে বার করে পায়ে দলে পিষে শেষ করে দেওয়াতেই আনন্দ ওঁর।
অতএব ওঁকে সুনন্দা ছেড়ে কথা কয় না। শুধু ভঙ্গিটা শান্ত আত্মস্থ। বাবার অসুখটা যে এত গুরুতর তা কী করে বোঝা যাবে বলুন? ভাবলাম তেমন হলে আপনি নিশ্চয় পুজো পাঠ ফেলে এসে কাছে বসতেন।
পুজো পাঠ ফেলে? কাছে এসে বসতাম? বিজয়া চেঁচিয়ে ওঠেন,তোমাদের কালের মতন শিক্ষা আমরা পাইনি বউমা! চব্বিশ ঘণ্টা স্বামীর অঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষিরও অভ্যেস নেই, রোগ হলে ডাক্তার ডাকতে হয় তাই জানি, ঠাকুর-দেবতার কাছে কেঁদে পড়তে হয় তাই জানি, শিয়রে গিয়ে না বসলে যে কর্তব্য হয় না তা জানি না। তবে তুমি ছেলের বউ হয়ে—
ও-ঘর থেকে উঠে আসে মীনাক্ষী, চাপা রাগের গলায় বলে, মা, তোমরা ভেবেছ কী? চিৎকারের চোটে যে ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঘুমও ভেঙে যাচ্ছে। আশ্চর্য!
চলে যায় মীনাক্ষী বিরক্তি ছড়িয়ে।
বিজয়াও তিরতিরিয়ে সরে যান। সরোজাক্ষর জন্যে তিনি এই ফাঁকে অনেক মানত-টানত করে নিয়েছেন, আর ভয় নেই।
আর ভয়টা তো কমেও গেল নীলাক্ষর কথায়। রোগটা আকস্মিক আর অকারণ নয়। কারণ আছে। মানী মানুষ, অপমানটা বুকে বেজেছে। তাই বে-এক্তার হয়ে গেছেন হঠাৎ।
কিন্তু বিজয়া এতে যেন রীতিমত একটা উল্লাস অনুভব করছেন। অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে দাঁড় করিয়ে বলে চলেছেন তিনি। দেখে বোঝো, অপমান জিনিসটার জ্বালা কত! জীবনভর এই একটা মেয়েমানুষকে অপমানই করে গেলে, তাকিয়ে দেখলে না তার কতটা লাগে।
তার শান্তি একটু পেতে হবে বইকী, ভগবান কি নেই?
খুব যে বলা হত, মানটা বজায় রাখা নিজের হাতে, রাখতে জানলে কারও সাধ্য নেই সেটা কেড়ে নেয়। এখন?
এখন বোঝো? অদৃশ্য সেই প্রতিপক্ষ উত্তর করে না। তবু বলেই চলেন বিজয়া মনে মনে।
মীনাক্ষী আবার বাবার ঘরে গিয়ে বসে। ৪০
আর ভাবতে থাকে বাবার এই অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ কি শুধুই বাবার ছাত্রদের ঔদ্ধত্য, অসভ্যতা, দুর্বিনয়?
বাবার সন্তানদের ব্যবহার একেবারে নম্র সভ্য বিনীত? এবং বাবা স্ত্রীরও তাই?
মীনাক্ষীর চিন্তা যেন একটা ঘড়ির পেণ্ডুলামে বাঁধা পড়েছে, তাই সে একবার দক্ষিণে হেলে, একবার বামে। দক্ষিণের দাক্ষিণ্য নিয়ে ভাবে বাবার মতো চরিত্রের লোকের পক্ষে এ চাপটা বাস্তবিকই দুঃসহ। ঘরে বাইরে এই অসভ্য অস্ত্র উদ্ধত ব্যবহারের ভার বহন করতে করতে বাবার স্নায়ুরা সহনক্ষমতা হারিয়ে বসেছে।
আবার ক্ষণপরেই বাপের বিরূপতা নিয়ে ভাবতে বসে। কিন্তু ওঁরা কেন এই যুগকে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে দেখবেন না? কেন এখনও বালির গাদায় মুখ গুঁজে বসে অতীত যুগের স্বপ্ন দেখবেন? কেন ওঁদের এখনও এত প্রত্যাশা, এত ভাবপ্রবণতা?