কিন্তু পরিস্থিতির চেহারা দেখে দামি জিনিসগুলি সামলাবার চেষ্টা করেননি সরোজাক্ষ, বিনা বাক্যে খুলে দিয়েছিলেন ঘড়ি আংটি বোতাম, গায়ের শাল। পকেট থেকে পার্স। মাত্র সাতটি পয়সা চেয়ে নিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে মৃদু হেসে, বলেছিলেন, এত রাত্রে পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে যেতে বড় বেশি কষ্ট হবে।
কিন্তু আজ বিনা বাক্যে এককথায় ওদের দাবি মেনে নিতে পারেননি। ঘড়ি আংটির থেকে অনেক বেশি দামি একটা জিনিস রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলেন প্রথমটায়। ওরা যখন ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল ক্ষমা চাইতে হবে স্যার, মাপ চেয়ে কথা ফিরিয়ে নিতে হবে–তখন তিনিও ঠাণ্ডা গলায় বলেছিলেন, অন্যায় কিছু বলে থাকলে নিজেই ফেরত নিতাম, নিজেই ক্ষমা চাইতাম।
একটা ছেলে, হয়তো অধ্যাপকের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিশীল, সে এসে গলা নামিয়ে বলেছিল– তা শ্রদ্ধাশীল সহানুভূতিশীল ছেলে যে একেবারেই ছিল না তা নয়, ছিল। অনেক ছিল। হয়তো তারাই সংখ্যায় বেশি, কিন্তু তাদের সাহস ছিল না সহপাঠীদের এই অসভ্যতার প্রতিবাদ করবার। কারণ তারা দলের শিকার। তারা জানে তারা যে মুহূর্তে প্রতিবাদ করবে, সেই মুহূর্তে বন্দুকের মুখ ঘুরে যাবে। তাই তারা বিপন্নমুখে একে ওকে মৃদু অনুযোগ করছিল, না না, এটা ঠিক হচ্ছে না। এতটা করার কোনও মানে হয় না।
কিন্তু তাদের আবেদন ধোপে টেকেনি, কারণ তারা সংখ্যাগুরু হলেও দলের কাছে তাদের হার। স্বাধীন চিন্তার স্বাধীন মত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করবার সাহস বা শক্তি তাদের নেই। ব্যক্তিস্বাধীনতার রাংতায় মোড়া একটা অমোঘ দাসত্বের যূপকাষ্ঠের বলি তারা।
তাই তাদের একজন গলা নামিয়ে পরামর্শের সুরে বলেছিল, যা হোক করে দুটো কথা বলে ওদের শান্ত করে ফেলুন স্যার, বড় ভয়ংকর ছেলে ওরা। ছুরি বার করতেও পিছপা হয় না।
তবু তখনও সরোজাক্ষ হিসেব করতে পেরে উঠছিলেন না কোনটাকে বেশি দামি বলে ধরবেন, নিরাপত্তা না আত্মসম্মান?
তাই তখন বলেছিলেন, দেখা যাক কতদূর করতে পারে।
বলেছিলেন। কারণ তখনও ভেবেছিলেন কদিন ঘেরাও করে রাখতে পারে রাখুক। দেখি কদিন চলে এই নাটক। আমাকে আমি সে নাটকের দর্শক ছাড়া আর কিছু ভাবব না।
ওঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছেলেটি বলেছিল, সামান্যর জন্যে ভয়ানক মুশকিলে পড়ে যাবেন স্যার।
সরোজাক্ষ যেমন ছিলেন সেই ভাবেই বলেছিলেন, সামান্য কিনা তাই হিসেব করছি।
.
কিন্তু শেষ পর্যন্ত অঙ্কটা কষা হল না।
সংখ্যাগুলো যেন ছড়িয়ে ছত্রখান হয়ে গেল। বেশ কয়েক ঘণ্টা বসে থাকার পর ক্লাস-রুমের ধারের হল-এর ফোনটা বেজে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ছেলে সেটাকে তুলে নিয়ে বলতে শুরু করল,ওঃ, স্যারের বাড়ি থেকে বলছেন? দেখুন ফিরতে তাঁর একটু দেরি হবে, বিশেষ একটা ব্যাপারে আটকা পড়ে গেছেন।…কখন মিটবে? তা বলতে পারছি না, সেটা ওঁর নিজের হাতে।…না, মাপ করবেন, ওঁকে এখন ডেকে দেওয়া যাবে না
টেলিফোনটাকেও ঘেরাও করে রেখেছিল ওরা, কাজেই কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না সেটা ব্যবহার করা। না অন্য প্রফেসরদের, না শুভবুদ্ধি চাকর দারোয়ান কেরানিদের। অথচ সবাই একবার করে পুলিশের কথা ভেবেছে।
অধ্যাপক মৈত্র যেন এতক্ষণ কোনও একটা ঔষধের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে বসে ছিলেন। ওদের ঠাণ্ডা গলা ক্রমশই উত্তপ্ত হচ্ছিল, নিজেদের মধ্যেই তর্কাতর্কির মাধ্যমে চেঁচিয়ে উঠছিল–কিছুতেই না। অ্যাপলজি না চাইলে একটি পা নড়তে দেওয়া হবে না। জাদু ঘুঘুই দেখেছেন, এবার ফাঁদ দেখুন।…পুলিশ? কে ডাকবে? প্রিন্সিপাল? ডাকুক। দেখি কত মুরোদ..
সরোজাক্ষ যেন অবাক হয়ে শুনছিলেন কথাগুলো।
এরা পড়ত তাঁর কাছে?
বসে থাকত সভ্য চেহারা নিয়ে?
ক্রমশই যেন সেই আচ্ছন্নতা বাড়ছিল।
এই ফোন-এর ব্যাপারটার পর হঠাৎ যেন চমক ভাঙল। চিন্তার পরদায় আস্তে আস্তে ভেসে উঠল, বাড়ির লোকের ব্যস্ততা…লোক জানাজানি কাণ্ড, পুলিশের সাহায্য ভিক্ষা নিয়ে উদ্ধার…নিরাপত্তার আশ্বাসবাহী সুরক্ষিত ভ্যান-এ চড়ে পলায়ন…পরদিনের সংবাদপত্রের হেডলাইন, বন্ধু আত্মীয় হিতৈষিবর্গের বিস্ময় প্রশ্ন ও দার্শনিক মন্তব্য, তার সঙ্গে সহানুভূতি বারি।…কী লজ্জা কী লজ্জা!
তারপরে খেয়ালে এল দরজায় কিছু কিছু চেনা মুখ দেখেছিলেন যেন, হতাশ বিপন্ন উদ্বিগ্ন নিরুপায়।
হয়তো সেই মুখেরা কিছু বলতেও চেষ্টা করেছিল এই উন্মত্তগুলোকে লক্ষ্য করে, তারপর আস্তে সরে গিয়েছিল। তার মধ্যে কি অধ্যক্ষের মুখও ছিল? মনে করতে পারছেন না। হয়তো ছিল। হয়তো ঈষৎ বিরক্তিও ছিল তাতে।
যেন সে বিরক্তিতে অভিযোগের ছায়া, কী আবার ঘটালে বাপু? নাও এখন বোঝে। জানো তো বিষধর সর্প নিয়ে বাস আমাদের, কেন আবার তাদের ল্যাজে পা দিতে যাওয়া।
অর্থাৎ ওঁরা দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসবেন না।
সংকল্পে ভাঙন ধরল।
কেলেঙ্কারির দৃশ্যগুলো মাথা তুলে দাঁড়াল। আপস করতে হল। ওদের সঙ্গে নয়। নিজেরই সঙ্গে। ভবিষ্যতের কর্মপন্থা ভবিষ্যতে স্থির হবে, এখন এই অবস্থার অবসান দরকার। নচেৎ আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো তাঁর বড় ছেলে সরেজমিনে তদন্ত করতে আসবে কোন জটিল কর্মর্জালে আটকা পড়ে আছে তার বাবা। গোঁয়ার প্রকৃতির ছেলে, হয়তো থানা-পুলিশ কাণ্ড করে পরিস্থিতি নরক করে তুলবে।