ঘোমটার কথা হচ্ছে না–নীলাক্ষ বিরক্তির গলায় বলে, চাকরবাকরদের সামনে একটা প্রেস্টিজ রাখা উচিত।
উচিত বুঝি? সুনন্দা ঘাড়ে গলায় মুঠো মুঠো পাউডার মাখতে মাখতে বলে, তোমার পা দুটোর গতিবিধি যেমনই হোক ব্রেনটা কিন্তু ঠিক জায়গায় আছে বলতে হবে। একেবারে কারেক্ট চলছে।
তার মানে?
মানে অতি প্রাঞ্জল। একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে।
নীলাক্ষর বিরক্ত গলায় বলে, সভ্যতা শালীনতা বলে একটা জিনিস আছে।
সভ্যতা! শালীনতা! ওরে বাবা, এ যে ভাল ভাল বাংলা সাহিত্য-টাহিত্য করছ নাকি আজকাল?
আমাকে ডাউন করতে পেলে তো আর কিছু চাও না। কিন্তু আমার শালীনতার মাপকাঠিতে তোমার ব্যাপারটা মাপা চলে না?
সুনন্দা পাউডার ঘষা স্থগিত রেখে রাজহংসীর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, চলে না কেন।
চলে না বলেই চলে না। নীলাক্ষ দুর্বল গলায় বলে, আমি যদি মদ খেয়ে খানায় পড়ে গড়াগড়ি দিই, লোকে বড়জোর হাসবে, কিন্তু
আমার ব্যাপারেও ওই একই কথা। সুনন্দা তার একটা পা খাটের উপর তুলে সুগঠিত সুন্দর গোছটায় ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলে, তা ছাড়া আর কিছুনয়। লোক হাসবে, আর কি? কিন্তু হাসার কথাই বা উঠছে কেন? সুনন্দা পা বদলায়, তেমন দৃশ্য দেখলে লোকে বরং ধন্যি ধন্যি করবে।…বলবে, কী চমৎকার কুসংস্কারমুক্ত। কী প্রগতিশীল।
এতক্ষণে আলনা থেকে একটা শাড়ি টেনে নিয়ে জড়ায় সুনন্দা।
নীলাক্ষ বিরস গলায় বলে, তোমার কথাবার্তাগুলো ক্রমশই এত কটু হয়ে উঠছে
সুনন্দা হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। যে হাসিটা ও কিছুকাল ধরে রপ্ত করে করে শিখেছে। আর সেই হাসির গলাতেই বলে, তাইনাকি? কবে থেকে গো?কবে থেকে আমার কথা কটু লাগতে শুরু করল? মিসেস সিনহার সঙ্গে আলাপ হয়ে পর্যন্ত বুঝি?
মিসেস সিনহা। মিসেস সিনহা মানে? নীলা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলে, এর মধ্যে আবার থার্ড পার্টির কথা আসছে কোথা থেকে?
তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাবেই তো দুজনের মাঝখানে কটু তিক্ত লবণাক্ত স্বাদের সৃষ্টি হয়।
পাখার রেগুলেটারটা শেষ পয়েন্ট অবধি ঠেলে দিয়ে সুনন্দা এবার বিছানার পাশে রাখা সোফাটায় হাত পা ছড়িয়ে বসে।
নীলাক্ষ আবার উঠে বসে, ক্রুদ্ধ গলায় বলে, তা বললে তো অনেক আগেই সেটা সৃষ্টি হতে পারত। মিস্টার মেহেরার সঙ্গে যেভাবে গা গড়িয়ে মেলামেশা করো তুমি, তাতে
কথা শেষ করতে পারে না নীলা, একখানা শার্সি ভেঙে পড়ে যেন। হ্যাঁ, সুনন্দা ওই কাভাঙা সুরের হাসিটা রীতিমত রপ্ত করেছে। সেই হাসির ঝাঁপটায় কথার শেষটা আর এগোয় না। হাসিটাই কথা হয়ে এগোয়, তাতে যে-কোনও স্বামীরই রক্ত টগবগিয়ে ফুটে উঠত, তাই না? তবে নেহাত না কি এক্ষেত্রে রক্তের বদলে বরফ জল, তাই আর ফুটে ওঠে না।
এই কটু তিক্ত লবণাক্তর উত্তরে কী বলত নীলাক্ষ কে জানে, কিন্তু উত্তর দেওয়া হল না। পরদার ওপিঠে বিজয়ার চাঁচা-ছোলা ধারালো গলাটি বেজে উঠল, ছ ঘণ্টা বউ নিয়ে বেড়িয়ে এসেও আবার ঘরে বসে বউয়ের সঙ্গে হাসি-মশকরা করছিস নীলে? গায়ে কি মানুষের চামড়া নেই তোর? এদিকে বাপ মরতে পড়েছে।
সুনন্দা সাড়া দেয় না, সুনন্দা শুধু উঠে বসে। সুনন্দার কপালটা একটু কুঁচকে যায়।
নীলাক্ষ দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। নীলাক্ষর বোধ করি নেশা ছুটে এসেছিল, তাই ঈষৎ অপ্রস্তুত গলায় বলে, এসেই তো বললাম ডাক্তার এসেছিল কেন? তা কা কস্য পরিবেদনা! কেউ জবাবই দিল না।
বাপ অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে দেখতে পাসনি বুঝি? বিজয়ার কণ্ঠে জগতের ধিক্কার।
আড়ালে নীলাক্ষ অনেক কিছুই করে, এই সনাতন বাড়ির ছেলে হয়েও নীলাক্ষ মদ ধরেছে, বউকে নিয়ে বাইরে নাচাচ্ছে, তবু মায়ের তীব্রতার সামনে মুখোমুখি দাঁড়ালেই নীলাক্ষ যেন কেমন অসহায়তা বোধ করে।
আর তীব্র তো বিজয়া সব সময়।
আত্মসম্মান বোধের মাপকাঠি বিজয়ার সরোজাক্ষর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর মতে এ-যুগ ভালমানুষীর যুগ নয়, ভদ্রতার যুগ নয়। তোমার ভদ্রতায় অন্যে ভদ্র হবে, এ আশা বাতুলের আশা। বরং সেই ভদ্রতার সুযোগটা নেবে সে আঠারো আনা। তবে ভদ্রতায় লাভ?
লাভের জন্যে ভদ্রতা নয়, ভদ্রতার জন্যেই ভদ্রতা–সরোজাক্ষর এ মতবাদে বিশ্বাসী নন বিজয়া। তিনি বলেন, আর কিছু না হোক, দুকথা শুনিয়ে নেবার সুখটাই বা ছাড়ি কেন? যাচ্ছেতাই করে শুনিয়ে আমি দেবই সবাইকে। মেয়ে জামাই ছেলে বউ আত্মীয় বন্ধু কাউকে ছেড়ে কথা কইব না। হক কথা কইব, ভয়টা কাকে?
বিজয়ার শুনিয়ে দেবার বদলে অপর পক্ষও শুনিয়ে দিলে, আরও গলা তুলবেন তিনি, আর শেষ অবধি বিজয়িনীর গৌরব নিয়েই ফিরবেন।
নীলাক্ষ বলে, দেখতে পাব না কেন? তা তোমার ছোট কন্যে তো কথাই কইল না, বুঝব কেমন করে কী হয়েছে?
হয়েছে ব্লাডপ্রেসার বৃদ্ধি। বিজয়া কেমন নিষ্ঠুর গলায় বলেন, স্ট্রোক হতে হতে হয়নি এই আর কি! তবে ধরনটা তাই।
নীলাক্ষর কণ্ঠস্বরে নেশার আভাস বিদ্যমান, তবে কথার মধ্যে যুক্তির অভাব নেই। মার কথার উত্তরে বলে, হলেও আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না। কলেজেই স্ট্রোক হতে পারত। বাবার মতন লোককে দিয়ে অ্যাপো-ইয়ে, ক্ষমা চাইয়ে নিয়েছে, সোজা কথা!
বিজয়া ভুরু কুঁচকে তাকান, কী চাইয়ে নিয়েছে?
ক্ষমা! স্রেফ হাতজোড় করিয়ে
কে? বিজয়া অবাক হন, কে চাইয়ে নিয়েছে?