ও ঘরে গিয়ে? ওঃ! অসুখটা কী?…মনোভঙ্গ? ব্লাডপ্রেসার? স্ট্রোক?
অসমান পায়ে চলে যায় নিজের ঘরে।
মীনাক্ষী সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। মীনাক্ষীর চোখের সেই ছায়াটা আরও নিবিড় হয়।
সে ঘৃণা গিয়ে পড়ে আর এক অন্তরালবর্তিনীর উপর।
বউ এসে গটগটিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। খোঁজও করলেন না ডাক্তার এসেছিল কোন প্রয়োজনে। বোধ করি তাঁরও পায়ের ঠিক নেই, আর সেটা ঢাকতেই তাড়াতাড়ি
অথচ ওই বউ আগে কী ভিজে বেড়ালটিই ছিল!
মীনাক্ষীর চিন্তা বর্তমানের সব কিছু থেকে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নীলাক্ষর বউ সুনন্দার সদ্যবধূজীবনের অধ্যায়খানার সামনে।…ভিজে বেড়াল, স্রেফ ভিজে বেড়াল, আস্তে আস্তে কথা, কথায় কথায় মাথায় ঘোমটা টানা, শাশুড়ি ননদের মনোরঞ্জনের চেষ্টায় তাদের পায়ে পায়ে ঘোরা! কত ভেক্!…আর মেয়েই বা কী ঘরের! মীনাক্ষী অজ্ঞাতসারেই নাকটা কোঁচকায়, সেই তো নেহাত গরিব গেরস্ত ঘর, মা এখনও কয়লাগুঁড়োয় গুল দেয়, ক্ষার কাঁচে। বাবারই বা কী ছিরি! গাঁইয়া বুড়ো, চটের থলি হাতে ঝুলিয়ে বাজার যাচ্ছেন, রেশন আনছেন। মায়ের অঙ্গে শেমিজ ব্লাউজ কদাচ ওঠে (মীনাক্ষীর মায়ের অঙ্গে যে সেই কদাচটিও ওঠে না, তা মনে পড়ে না মীনাক্ষীর। সুনন্দার মার চেহারাই মনে পড়ে তার)। রাতদিন লক্ষ্মী-ষষ্ঠী-ইতু-মনসা-ঘেঁটু-ভাদু নিয়ে পড়ে আছেন!..বউদিই বা কী? মীনাক্ষী ভাবে, সেও তো যখন এল, তখন কত কী ব্রতট্রত করত। বলেছিল, ধরা ব্রত চার বছর করতেই হয়, আর উদ্যাপনও করতে হয়, নইলে পতিত হয়।
সুনন্দার ওই বোকা বোকা সেকেলে সেকেলে কথা শুনে মীনাক্ষীরা দুই বোন হেসে কুটিকুটি হত। আর বলত, একটু বর্তমান হও বাবা, একেবারে অতীত যুগ হয়ে থেকো না।
তবু সুনন্দা এক বছর ধরে এয়ো সংক্রান্তি করেছিল। মাস শেষ হলেই যত এয়ো ধরে ধরে তাদের পা পুজো করতে বসত। কী সাজ তখন মহিলার! সোজাসুজি বাঙালি করে শাড়ি পরা, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর, তেল জবজবে চুলে ইয়া এক খোঁপা বাঁধা, গলায় আবার বড় বড় মটর দানার মালা! এককথায় যেন গাঁইয়া নম্বর ওয়ান! দাদা যদি কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইত, কি সিনেমা যেতে চাইত, ভয়ে লজ্জায় একেবারে দিশেহারা। বলা হত, একলা যাব কি? ঠাকুরঝিরাও চলুক না।
ঠাকুরঝি!ননদদের ঠাকুরঝি বলত সুনন্দা। মীনাক্ষীরাই হেসে ঠাট্টা করে সে ডাক ছাড়িয়েছে। দিদি বলেছে, দাদার সঙ্গে একা যেতে তোমার ভয়? কেন? পরপুরুষ নাকি? সেই মেয়ের পেটে পেটে এত ছিল। উঃ!
দিদিই তো বলতে গেলে ওকে সাজসজ্জায় মানুষ নামের যোগ্য করে তুলেছিল। আর এখন? এখন বেহেড দিদিটাও ওর সজ্জা দেখলে লজ্জা পায়। নেহাত পুলিশে ধরবার ভয়েই বোধ হয় বিবসনা হয়ে বেড়ায় না, সে ভয় না থাকলে তাও বেড়াত! আর কথাবার্তাই বা কী এখন! ইংরিজি বুকনি, মিহি গলা, বেপরোয়া বোলচাল!..আগে দাদা বউকে একটু ফ্যাসানি করবার জন্যে মাথা খুঁড়েছে, এখন বোধহয় বউয়ের কায়দাকানুন দেখে মাথা খুঁড়ছে। এঁয়োপোকা থেকে যে প্রজাপতি হতে পারে, বউদিই তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ! তার মানে ভিতরে ভিতরে ছিল সব, ওপরে দেখাত ওই ধড়িবাজি। শুনতে পাই দাদার ব্যবসার উন্নতির কারণই নাকি সুন্দরী স্ত্রী। কে জানে স্বভাব চরিত্রই বা—
এখানে থামে মীনাক্ষী। অর্থাৎ ভাবনাটাকে থামায়। ভাবে, যাকগে আমার কি? দাদাই বুঝবে। তবে ভোলটা ফিরিয়েছে বটে এ বাড়ির বউ। এত যে তটস্থ থাকত বাবা বাবা করে, এখন তো সে বাবার ছায়াও মাড়ায় না। আর শাশুড়ি-ননদদের সঙ্গে যদি কথা কইল তো ব্যঙ্গের সুরে ভিন্ন নয়। এ সংসারের সবাই যেন উপহাসের পাত্র।
মানুষ কত বদলাতেই পারে। বিশেষ করে মেয়েমানুষ! মীনাক্ষী নড়েচড়ে বসে। ভাবে, অবশ্য সব মেয়েমানুষ নয়। যাদের মধ্যে বস্তু নেই তারাই পারে দেবী থেকে দানবী হতে, শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হতে। এটা ঠিক, দাদাই দিয়েছে আশকারা। দাদাই করেছে এটি, কিন্তু করলেই তাই করবি তুই?
নিজের একটা সত্তা নেই? এবাড়ির প্রজাপতি হয়ে ওঠা বউয়ের বিরুদ্ধে চিন্তা করতে করতে নিজের কথা ভুলে যায় মীনাক্ষী। ভুলে যায় দিবাকর নামের একটা দাঁতাল প্রাণী তার সত্তাকে কীভাবে নিঃশেষে গ্রাস করতে বসেছে।
.
বাইরের সাজসজ্জা খুলে ফেলে, শুধু একটা টাইটবডি আর পেটিকোট পরে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সুনন্দা। চুলটাকে রাতের উপযুক্ত করে টেনেটুনে একটা বেণী বাঁধছিল, ঘষে ঘষে ক্রিম মাখছিল সর্বাঙ্গে। নীলাক্ষ ভোম্বলের মতো পড়ে ছিল বিছানায়।
দরজার বাইরে একটা মৃদুকণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল, সুনন্দা গালে ক্রিম ঘষতে ঘষতেই পরদাটা সরিয়ে বলল,আমরা আজ আর খাব না, খেয়ে এসেছি।
বলে ফিরে এল আবার। ক্রিমের শিশিটার গহ্বর প্রায় শূন্য করে বাহুমূলে লাগাল মোটা আঙুলের পোঁচড়ায়, শিশির ঢাকনি বন্ধ করল, আবার ডলবে ভাল করে।
নীলাক্ষ উঠে বসে ভুরু কুঁচকে বলল,কে কথা বলল?
সুনন্দা তাচ্ছিল্যের গলায় বলল,নিতাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, এখন খাব কি না। বলে দিলাম খাব না।
নীলাক্ষ বিরক্তির গলায় বলে ওঠে, তুমি এভাবে বেরোলে তার সামনে?
সুনন্দা অবিচলিত ভঙ্গিতে বলে, ইস তাই তো! ভারী অন্যায় হয়ে গিয়েছে তো। ঘোমটা দেওয়া উচিত ছিল।