ভাল? সারদাপ্রসাদ বিরক্ত গলায় বলে, তারপর? পরিণামটা? হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সারদাপ্রসাদ, পরিণামটা কী জানো? ওই ফ্রাস্টেশান ব্যাধিগ্রস্ত জগৎ কাজ ছেড়ে দেবে, চেষ্টা ছেড়ে দেবে, বেঁচে থাকবার জন্যে যেসব আয়োজন, তাতে পরাত্মখ হবে। হয়ে ক্রমশ কাপড় পরা ছেড়ে, কাঁচা মাংস ধরে, কোটি কোটি বছরের সাধনা মুছে ফেলে সাবেককালের গুহ্য-জীবনে ফিরে যাবে।
উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকে সারদাপ্রসাদ।
এই উত্তেজিত মূর্তির দিকে তাকিয়ে হাসিটা আর চেপে রাখতে পারে না মীনাক্ষী। হেসে উঠে বলে, সেটা আপনার আমার জীবদ্দশায় হবে না আশা করছি
সারদাপ্রসাদ এই ব্যঙ্গে হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। তারপর কড়াগলায় বলে, তোমাদের মতো ফাজিল ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি। যাও, নিজের কাজে যাও।
অর্থাৎ ঘর থেকে বিদায় হও। অপমানে মীনাক্ষীর মুখটা লাল হয়ে ওঠে। সেও পাথুরে গলায় বলে, যাচ্ছি।
সারদাপ্রসাদ আপন অধিকারের সীমা সম্পর্কে চিন্তা করে না। বলে, হ্যাঁ যাও। আমার কাজ আছে। প্রায় ওকে ঠেলে ঘরের বাইরে বার করে দিয়ে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দেয় সারদাপ্রসাদ।
হ্যাঁ, এরকম রেগে ওঠে সে।
কিন্তু সে রাগ শরতের মেঘ। ভুলে যায়। হয়তো কালই আবার মীনাক্ষীকে ডেকে বলবে,ওহে আধুনিকা, শোনো শোনো–আজকের এই হতভাগ্য ভারতবর্ষের প্রাচীনকালে কী ছিল শোনন–
মীনাক্ষীও পাগল ছাগল বলে ক্ষ্যামা ঘেন্না করে থাকে পিসেমশাইকে, দাদা বা দিদির মতো তীব্র একটা আক্রোশ নেই লোকটার উপর। কিন্তু আজ সে বড় ক্রুদ্ধ হয়েছে। আর এই ক্রোধটা হয়তো নানা কারণ সঞ্জাত।
হয়তো বিজয়া যা বলেছেন সেটাও একটা কারণ, আড্ডায় আড়াই হয়, খাওয়াটা হয় না।একেবারে হয় না তা নয় অবশ্য, হয়। হয়তো বা এক পেয়ালা কফি, হয়তো বা চা আর অমলেট। বেশি খাওয়ার রেস্ত কোথায়? দুজনেই তো পড়ুয়া। দিবাকর অবশ্য তাদের দেশের জমিদারি আর বিজনেসম্যান বিরাট মামার গল্প অনেক করে, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই দেখা যায় ও পার্সটা ভুলে এসেছে, কিংবা পার্সটা ভরে আনতে খেয়াল করেনি। তাছাড়া আর এক ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত দিবাকর তুচ্ছ ক্ষুধাতৃষ্ণার ধারই ধরতে চায় না যেন। সেই প্রথম পরিচয়কালের মতো কফি হাউসে এক ঘণ্টা অথবা গঙ্গার ধারে পঁয়তাল্লিশ মিনিট-এর মনোরম স্বাদ প্রায় ভুলেই গেছে মীনাক্ষী। এখন ভূমিকাটা অনেকটা অভিযুক্ত ও অভিযোক্তার। মীনাক্ষী আছে কাঠগড়ায় যেন অন্ধ কুসংস্কারের জ্বলন্ত নিদর্শন হয়ে, আর দিবাকর। প্রতিপক্ষের উকিলের ভূমিকায়। দিবাকরের প্রত্যেকটি অভিব্যক্তিতেই তাই শাণিত বিদ্রূপ আর তীক্ষ্ণ সমালোচনা। দিবাকর তাই সর্বদাই উগ্ৰ অসহিষ্ণু।
ভালবাসার মধুর স্বাদটা যে কী, তা জানে না মীনাক্ষী। জানে না তার স্নিগ্ধতা, সরসতা, পূর্ণতার স্বাদ। মীনাক্ষীর প্রেমাস্পদ ওকে দেয় শুধু একটা তীব্র জ্বালার অনুভূতি। প্রতিক্ষণই তাই মনে হয় মীনাক্ষীর, আপন জীবনে সে নিরুপায়, সে বন্দিনী, সে একটা কঠোর শাসনের তলায় নিষ্পেষিত। যে শাসনটা অন্যায়।
সব কিছু মিলিয়ে মীনাক্ষীও যেন ভারসাম্য হারাচ্ছে।
তাই আজ মীনাক্ষী, যা হয়তো সে ঘণ্টাখানেক পূর্বেও কল্পনা করতে পারেনি, তাই করে বসে। সারদাপ্রসাদের ঘর থেকে বেরিয়ে তীব্র বেগে বাবার ঘরের পরদাটা সরিয়ে ঢুকে পড়ে বিনা ভূমিকায়। বলে ওঠে, বাবা, আপনার কি মনে হয়, পৃথিবীতে কিছুদিন আগে এসে পড়ার অধিকারে যাকে যা খুশি অপমান করা যায়?
২. ঘুমন্ত ছেলেটা
সুনন্দা দোতলায় উঠে ঘুমন্ত ছেলেটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেছে। নীলাক্ষ ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে ধীরে ধীরে অসমান পায়ে দোতলায় উঠে এসে জড়িত গলায় প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার! ডাক্তারকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম মনে হল।
প্রশ্নটা শূন্য দালানকে, তাই উত্তর মিলল না।
নীলাক্ষ অতএব বাবার ঘরের পরদা সরিয়ে আর একবার উচ্চারণ করল প্রশ্নটা।
মীনাক্ষী বিছানার ধারে একটা চেয়ারে বসে ছিল, খাটের উপর সরোজাক্ষ শুয়ে। চোখ বোজা। জেগে আছেন কি ঘুমিয়ে আছেন বোঝা যাচ্ছে না।
মীনাক্ষীও শূন্য দালানের ভূমিকাতেই স্থির থাকল। শুধু একবার চোখটা তুলে তাকাল। সে চোখে ঘৃণার ছায়া।
একটা নেশায় টলমল মানুষকে দেখে ঘৃণা ছাড়া আর কোন ভাবেরই বা উদয় হবে!
ওঃ অসুখটা তা হলে বাবার!
নীলাক্ষ তেমনি জড়িত গলাতেই বলে, হওয়াই স্বাভাবিক! কলেজে তো আজ বেশ একখানি নাটক হয়ে গেছে। ঘেরাও নাটক! আরে বাবা, কলেজটা বাড়ি নয় যে, যাকে যা খুশি বলে পার পাবে! ও হল গিয়ে কেউটের বাচ্চার আচ্ছা। সেখানে তুমি গিয়েছ তাদের ল্যাজে পা দিতে।
মীনাক্ষী এই রোগীর ঘরে বাঁচালতার বিরুদ্ধে হয়তো রুক্ষভঙ্গি নিত, কিন্তু নীলার মন্তব্যটা অভাবিত বিস্ময়কর, তাই নিষেধ করতে ভুলে গিয়ে তাকিয়ে থাকে।
নীলাক্ষ স্ফুর্তির সঙ্গে বলে চলে, হঁ বাবা, এ হচ্ছে ঘেরাওয়ের যুগ, কথাটি কয়েছ কি ঘেরাও। নাও এখন বুঝলে তো ঠ্যালা। হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে তবে
সরোজাক্ষকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে, সেই ওষুধের ক্রিয়ায় এখনও আচ্ছন্নই আছেন হয়তো, তবু যেন মনে হল মীনাক্ষীর, শয্যাগতের কপালটা একটু কুঁচকে উঠল। হয়তো সত্যি নয়। হয়তো তার মনের ভ্ৰম, তবু সে নিচু অথচ দৃঢ়গলায় বলে, ও ঘরে গিয়ে কথা বলল।