সেদিন মায়ের সামনে এসে দাঁড়াতে অস্বস্তি হয়। মনে হয় মায়ের চোখ দুটো সার্চলাইট হয়ে মীনাক্ষীর ভিতরটা সমস্ত দেখে ফেলছে। দেখে ফেলছে ওই গহ্বরের সংকেতটাও। হয়তো মা হঠাৎ ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলে উঠবে, কী গো তোমরা একালিনীরা, আমাদের সন্দেহ বাতিক নিয়ে বড় যে ধিক্কার দাও, এখন কী হচ্ছে? ঘি আর আগুনের প্রবাদটা খেটে যাচ্ছে না?
কিন্তু কে আগুন, কে ঘি?
মীনাক্ষীই তো গলে গলে যাচ্ছে, মীনাক্ষীই তো আগুনের আঁচে পাখা পোড়াতে ছুটছে।
কী তীব্র আকর্ষণ সেই বন্য বর্বরতার, কী সৌন্দর্য সেই পুরু পুরু ঠোঁটজোড়ার, সেই জ্বলন্ত আগুনের ঢেলার মতো দুটো চোখের!
কিন্তু আকর্ষণের অন্তরালেই তো ভয়ের বাসা।
অতএব বাবার সামনে এসে দাঁড়াতেই পারা যায় না দিবাকরের সান্নিধ্য থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে। নিজেকে কেমন যেন অশুচি অশুচি লাগে, মনে হয় বাবার দৃষ্টিতে দেখতে পাবে ঘৃণা আর হতাশা। যেন সে দৃষ্টি অনুক্ত হলেও তীব্র প্রশ্ন করে উঠবে,ছি ছি মীনাক্ষী, তুমি এই! এই তোমার রুচি!
অতএব প্রথম নম্বর এই পাগলের ঘরটায় ঢুকে পড়া শ্রেয়।
এই আত্মনিমগ্ন খ্যাপা লোকটা তাকিয়ে দেখবে না। দেখবে না মীনাক্ষীর কোথায় কোথায় লেগে রয়েছে একটা বন্যসুখের স্বাদ।
সারদার আবিষ্কার সম্পর্কে প্রশ্ন করলেই সারদা উল্লসিত হয়, উত্তেজিত হয়। আজও হল। বলে উঠল, আবিষ্কার কিছুই নয়, সবই রয়েছে জাজ্বল্যমান, শুধু তাকিয়ে দেখার ওয়াস্তা। শুধু পূর্বপুরুষের বুদ্ধির প্রতি একটু শ্রদ্ধা রেখে বিচারটা করা। তা নয়–গোড়া থেকেই তোমরা ধরে বসে আছ, তোমাদের জেনারেশনের আগে পর্যন্ত সবাই বুদ্ধ ছিল। হচ্ছিল সেই কথা দাদার সঙ্গে। একটা তুচ্ছ কথাই ধরো না–এই যে খাদ্যাখাদ্য বিচার, এই যে বার তারিখ তিথিনক্ষত্র ধরে ধরে খাদ্যগুণের হিসেব কষা, যা নাকি করে গিয়েছেন আগেকার পণ্ডিতরা, তার সম্পর্কে শ্রদ্ধা নিয়ে চিন্তা করে দেখেছ কোনওদিন তোমরা? দেখোনি। স্রেফ উপহাসের হাসি হেসে রায় দিয়ে রেখেছ সেকালের লোকগুলোর কোনও কাজকর্ম ছিল না, তাই বসে বসে লিখে রেখেছে তেরোদশীতে বেগুন খেলে মহাপাতক, প্রতিপদে কুম্মাণ্ড খেলে জাতিপাত।
আরে বাবা, ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণ হাইজিনিক তা তলিয়ে দেখেছ? তা দেখবে কেন? সেটা যে তোমাদের মতে বুন্ধুরা করে গেছে। এখন তোমাদের স্বর্গভূমি ওদেশ থেকে ফতোয়া আসুক ফেব্রুয়ারিতে মুলো খেলে ক্যানসার হয়, আর নভেম্বরে ওল খেলে কুষ্ঠ, তা হলে ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে–উঃ বিজ্ঞানের কী উন্নতিই করেছে ওরা! এইসব বুঝে ফেলেছে।
সারদা একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলে, অথচ এদেশ? কোন জন্মে উদ্ভিদ জগতের সব রহস্য জেনে বুঝে ফাঁস করে বসে আছে।
মীনাক্ষীর কাছে এসব কথা নতুন নয়, তবে উত্তেজিত সারদাপ্রসাদ সব সময় নতুনের মতো করেই বলে, কাজেই মীনাক্ষীও নতুন শোনার সুরেই বলে, তা বেশ তো পিসেমশাই, না হয় তাঁরা সব জেনে ফেলে বলে-টলে গেছেন, কিন্তু ওইসব ধর্মের ভয় দেখিয়ে কেন?
কেন? সারদাপ্রসাদের মুখে একটি অলৌকিক হাসি ফুটে ওঠে, কেন, বুঝতে পারছ না? মানুষ জাতটা যে আত্মঘাতী জাত! হিতাহিত জ্ঞানের বালাই মাত্র নেই। বিশেষ করে জনসাধারণ, মানে তোমাদের ওই গণদেবতারা। যাতে ক্ষতি, যাতে সর্বনাশ, সেইদিকেই ঝোঁক। অন্য প্রাণিজগতে কোনও বেনিয়ম আছে? কদাচ না। নিজেদের অনিষ্টকর কিছু করছে তারা? মোটেই না। কিন্তু মানুষ? নিজের অনিষ্ট নিজে ডেকে আনাই তার পেশা।
মীনাক্ষী সহসা কেঁপে ওঠে।
মীনাক্ষীর মনে হয় সারদাপ্রসাদ বুঝি তাকে উদ্দেশ করেই বলছে কথাটা। ৩৪
কিন্তু সারদার অভিযোগ কোনও ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়, নিতান্তই সমষ্টিগত ব্যাপার। তাই সে দুই হাত উলটে বলে–কাজে কাজেই তাদের হিত করতে, পাপ, পুণ্য, ধর্ম, অধর্ম, ভাল হওয়া, মন্দ হওয়া, অনেক কিছুর কোটিং মাখিয়ে ওষুধের বড়ি দিতে হয়। যাঁরা চিন্তাশীল, যাঁরা সমাজকল্যাণকামী, তাঁরা তাই সেই বুদ্ধির বশেই সবকিছুতেই ওই করতে নেই আর করতে হয়-এর ছাপ দিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু মানুষ তো আর চিরদিন অজ্ঞ থাকে না? থাকতে রাজি হয় না।
কথা কয়ে নিজেকে হালকা করে নিচ্ছে মীনাক্ষী, করে নিচ্ছে সহজ।
তবে মীনাক্ষীর এ প্রশ্নে সারদা কৌতুক হাসি হেসে ওঠে, অজ্ঞ থাকে না? থাকতে রাজি হয় না? বলি ওহে একালের বিজ্ঞ মেয়ে, ডাক্তার যখন প্রেসক্রিপশন দেয়, তুমি তার সব উপাদান জেনে, তার উপকারিতা বুঝে তবে খাও? তা তো খাও না? জানো লোকটা একটা বিদ্যে শিখেছে, সেই বিদ্যেটা প্রয়োগ করছে, তুমি তা থেকে লাভবান হচ্ছ। এও তাই। ডাক্তার যদি বোঝতে বসে কীসের মধ্যে কী আছে, তুমি তখন আর গ্রাহ্য করে খাবেনা,বুঝলে? সেকালের ডাক্তাররাও তাই ওই ধর্ম দেখিয়ে হিত করত লোকের। ওই পাপপুণ্য দেখিয়েই দিত স্বাস্থ্যশিক্ষা, সমাজশিক্ষা, শৃঙ্খলারক্ষার শিক্ষা। বলতে পারা যায় শাস্ত্র মানে লবুক!…কিন্তু তোমরা সেই লকে অবজ্ঞা করে স্বেচ্ছাচারিতাটি বেছে নিয়েছ। তাতে কী হচ্ছে? বলল কতটা লাভবান হচ্ছ তাতে? কচু। কচুপোড়া! সমস্ত সমাজটাই ফ্রাস্টেশানে ভুগছে।
মীনাক্ষী এই পাগলের কথা উড়িয়ে দিতে পারত। দেয়ও তাই, কিন্তু আজ যেন মীনাক্ষী এই হাস্যকর তর্কের মধ্যে থেকেই আপন যুক্তির শক্তি সংগ্রহ করতে চাইছে। তাই সে দৃঢ়গলায় বলে, অবোধের শান্তির চাইতে এই ফ্রাস্টেশানও ভাল পিসেমশাই।