ওই অনুভবটাই মনের মধ্যে অপমানের জ্বালা ধরায় মীনাক্ষীর। তাই নিজের ঘরে ঢুকে গিয়ে অকারণের যেন কী এক আক্রোশে ফুলতে থাকে সে, আর একা-একাই নিজের স্বপক্ষে বহুবিধ যুক্তি খাড়া করে বাবাকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
নীলাক্ষর আচরণটা তখন তার যুক্তির মালমশলা হয়। ছেলের বেলায় যে দিব্যি অম্লান বদনে মেনে নেন সরোজাক্ষ, আর মেয়ের বেলায় ভুরু কোঁচকান, এইটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মনে করে জবাব তৈরি করতে থাকে সে।
যাক, সেসব জবাব তৈরি তো পরের ব্যাপার। এখন সিঁড়ির তলায় চটি খুলে রেখে খালি পায়ে নিঃশব্দে ওঠার কৌশলে চলে যাবে সোজা তিনতলার মার ঠাকুরঘরের সামনে। ফিরেছে, সেটা যত তাড়াতাড়ি মাকে জানানো যায়।
বিজয়া যেই বলেন, এই এখন ফিরলি তুই? সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠতে পারে মীনাক্ষী, কেন, খুব রাত হয়ে গেছে? খাওয়া-দাওয়ার সময় হয়ে গেছে তোমাদের?না কি ঘুমের? তোমার ছেলে বউ ফিরেছে তো?
দিবাকরের কাছে হেয় হয়ে আসার শোধটা তোলে মায়ের ওপর।
বিজয়া হয়তো বলেন, দাদার দৃষ্টান্তটাই খুব ভাল কেমন? হয়তো বা বলেন, আমাকে শুনিয়ে কী হবে, আমি তোমাদের সংসারের কে? আমি তো এ সংসারের একটা আবর্জনা জঞ্জাল! আমার কাছে আসাই বা কেন? ফিরেছ বেশ করেছ, আমার বাবার মাথা কিনেছ, যাও এখন খাটে শুয়ে পা নাচাও গো
এইরকমই কথা বিজয়ার।
কিন্তু আজ বিজয়া অন্য সুরে কথা বললেন। মেয়ে গিয়ে ঠাকুরঘরের দরজায় দাঁড়াতেই চাপা গলায় বললেন, সোজা উঠে আসছিস, না বাপের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
সোজাই উঠে এসেছি।
ঠিক আছে। দেরি দেখে কিছু বললে, বলবি অনেকক্ষণ এসেছি, মার কাছে ছিলাম।
মীনাক্ষী এখন সাহসীর ভূমিকা নেয়। বলে কেন, খামোকা বাজে কথা বলতে যাব কেন?
বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবেনা।বিজয়া মুখভঙ্গি করেন, বাজে কথা তো বলোনা একটুও!
সেটা আবার তুমি কখন শুনলে?
বিজয়া মেয়ের চোখে চোখে তাকান। চাপা কঠোর গলায় বলেন,দেখ মীনা, তুই আমার পেটে জন্মেছিস বই আমি তোর পেটে জন্মাইনি। কোনটা সত্যি কথা আর কোনটা বাজে কথা, তা আমি চোখের চাউনিতেই টের পাই। এই আটটা সাড়ে আটটা রাত পর্যন্ত তুমি যে তোমার কোন বান্ধবীর বাড়ি বেড়াতে যাও, আর কোন লাইব্রেরিতে পড়তে যাও, তা আর আমার বুঝতে বাকি নেই। যা বলছি তোমার ভালর জন্যেই বলছি।
মীনাক্ষী মার চোখের থেকে চোখ নামিয়ে নেয়, তবু গলার স্বর সতেজ রাখে। বলে, আমার সবচেয়ে ভাল করা হয় মা, যদি একটা লোহার খাঁচা বানিয়ে তাতে ভরে রাখতে পারো আমায়।
খাঁচা? তোমরা খাঁচায় আছ? এ যুগের মেয়েরা? বিজয়া উত্তেজিত গলায় বলেন, উঃ কী বেইমান তোরা, কী বেইমান! হয়তো এরপর তোর বউদিও বলবে, আমি খাঁচায় বন্দিনী হয়ে আছি।
বউদির সঙ্গে আমার তুলনা কোরো না, মীনাক্ষী ক্রুদ্ধ গলায় বলে, দেখো তোমার ওই বউও একদিন মদ খেয়ে টলমল করতে করতে ফিরবে।
সেকথা কি তুই আমায় বোঝাতে আসবি? আমি তো চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি সে দৃশ্য।
হু! যত দোষ মেয়ের বেলায়।
মেয়েকে যে পরের বাড়িতে চালান করতে হবে।
দরকার নেই। মীনাক্ষী ভারী গলায় বলে, আমার জন্যে মাথা ঘামাতে হবে না তোমাদের।
তা জানি! বিজয়া কটুগলায় বলেন,তোমার ভাবনায় যে তুমিই মাথা ঘামাচ্ছ তা আমি খুব টের পাচ্ছি। এখন যাও কিছু খাওগে। রাতদুপুর অবধি যেখানে আড্ডা দাও তারা তো আর খিদের সময় খেতে দেয় না।
আমার খিদে পায়নি– মীনাক্ষী সর্বশরীরে একটা মোচড় দিয়ে বলে, আমি যাচ্ছি বাবার কাছে। জিজ্ঞেস করব বাবার পিসিদের কালটা এখনও আছে কি না। জিজ্ঞেস করছি, কলকাতা শহরের রাস্তাটা এখনই এই সন্ধেবেলাতেই মহিলাশূন্য হয়ে গেছে কি না।
কেন, ইচ্ছে করে কেঁচো খোঁড়বার কী দরকার?
অকারণ ভয়ে কাঁটা হওয়ার দরকারটা কী, তাও জানি না। মীনাক্ষী ভাবে, হঠাৎ উদ্ধতের ভূমিকা নিয়ে বলেই ফেলি আজ আমার কথা দিবাকরের কথা। হয়ে যাক–একটা হেস্তনেস্ত।
কিন্তু হঠাৎ যেন সাহসটা ফুরিয়ে যায়। তাই মীনাক্ষী আর না এগিয়ে বলে ওঠে, যাক, আমার কথা আর তোমাদের শুনে কাজ নেই। তুমি থাকো তোমার স্বর্গলোকে। বাবা থাকুন তাঁর উচ্চচিন্তার গজদন্ত মিনারে। দাদার স্বর্গ তো দাদা নিজেই রচনা করছে। আমার ভাবনা আমি ভাবব।
বলে পাক খেয়ে তরতর করে নেমে এসে বাবার ঘরের দিকে একটা কটাক্ষপাত করে ঢুকে পড়ে বাঁ দিকে সারদাপ্রসাদের ঘরে। আর আশ্চর্য কৌশলে মুখে একটা হালকা হাসির প্রলেপ মাখিয়ে নিয়ে সহাস্যে বলে, কী পিসেমশাই! নতুন কী আবিষ্কার করলেন?
.
পিসেমশাইকে নিয়ে মজা করবার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝেই এ-ঘরে এসে ঢোকে মীনাক্ষী। প্রশ্ন তোলে, নতুন কী আবিষ্কার করলেন পিসেমশাই?
মজা করা ছাড়াও আরও একটা উদ্দেশ্যও অন্তর্নিহিত আছে। কোথায় কোন অদৃশ্য কালির লেখায় যেন পড়ে নিয়েছে মীনাক্ষী, পিসেমশাইকে আত্মীয়ের পদমর্যাদা দিলে বাবাকে কিঞ্চিৎ সন্তুষ্ট করা যায়। আর–ডেকে কথা কওয়া মানেই তো আত্মীয়ের মর্যাদা দেওয়া।
কই, দিদি কি দেয় সেটুকু মর্যাদা?
বেড়াতে আসে, দু-চার ঘণ্টা কাটিয়ে যায়। একবার পিসেমশাইবলে উঁকিও মারে না। মীনাক্ষী উঁকি মারে। বিশেষ করে যেদিন দিবাকরের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আসতে একটু বেশি দেরি হয়ে যায়, যেদিন সেই মুক্ত হয়ে চলে আসবার সময় অনবরতই ভয় ভয় করে, মনে হয় পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে সরে যাচ্ছে একটা অতল গহ্বরের সংকেত জানিয়ে জানিয়ে।