দিবাকর যদি ওকে লুঠ করে নিয়ে যেতে পারত, হয়তো মীনাক্ষী লুঠ হয়ে যেতে দ্বিধা করত না। কিন্তু দিবাকরের চোখেই শুধু আগুন জ্বলে, দিবাকরের মোটা মোটা ঠোঁট দুটোতেই শুধু একটা সর্বগ্রাসী। ক্ষুধা জেগে ওঠে, কার্যক্ষেত্রে দিবাকর সেই মোড়ের কাছ থেকেই ছাড়াছাড়ি হয়। আর অন্তত একদিন একটা সুযোগ আহরণ করাবার জন্যে মীনাক্ষীকেই পীড়াপীড়ি করে।
মীনাক্ষীর বুক ধকধক করে, মীনাক্ষীর পায়ের নীচের মাটি সরে সরে যায়, মীনাক্ষী শুধু বলে, সবুর করো না বাপু, আর কিছুদিন সবুর করো।
সেই সবুর করাটাকে মীনাক্ষী ভবিষ্যতের কোনও একটা শুভলগ্নের তারিখ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে চায়।
যে নাকি পিছিয়ে পড়ে থাকবার ভয়ে অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে গলা বাড়ায়, ধর্মসতীত্ব সততা সভ্যতা সবকিছুকেই কুসংস্কার আর প্রথামাত্র বলে অবজ্ঞার চোখে দেখার ভান করে, তার কথা মীনাক্ষী জানে না। মীনাক্ষী লজ্জিত হয়।
লজ্জিত হয় নিজের সভ্যতা সততা ধর্মবোধ আর সতীত্ববোধের জন্যে। কিন্তু ওগুলো যে তার মজ্জায় মজ্জায়, তাই ত্যাগ করে উঠতে পারে না। মীনাক্ষী অতএব পতঙ্গের ভূমিকা নিয়ে আগুনের পাশে পাশে ঘুরে মরে।
সরোজাক্ষ তাঁর আত্মহারা কন্যার এই বিহ্বলতার সংবাদ জানেন না, তিনি তাঁর মেধাবিনী কন্যার পরীক্ষার রেজাল্টটাই জানেন। সেখানে মীনাক্ষী কোনওদিন বাবাকে হতাশ করেনি। অতএব মেয়ে সম্পর্কে আর কোনও কিছু জানবার চেষ্টা করেন না সরোজাক্ষ।
তবে ইদানীং বিনা চেষ্টায় আরও কিছু কিছু জানতে পেরে যাচ্ছেন, যেমন মীনাক্ষীর নাকি ক্রমশই বন্ধুসংখ্যা খুব বাড়ছে, আর মীনাক্ষী প্রায় প্রত্যেকদিনই কারও না কারও বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেরি করে বাড়ি ফেরে।
সরোজাক্ষ অবশ্য তাঁর মেয়ের এই দেরি করাটা মোটেই পছন্দ করেন না, কিন্তু অপছন্দর প্রকাশ তো তাঁর শুধু মুখটা একটু কোঁচকানো, এ ছাড়া আর কি? আর কি করবার ক্ষমতা তাঁর আছে?
তথাপি ওইটুকুতেই ভয়।
ওইটুকুতেই মীনাক্ষী সন্ত্রস্ত হয়, ওইটুকুর জন্যেই তার বন্ধুর সঙ্গে রাস্তার মোড়ের কাছ থেকেই ছাড়াছাড়ি, ওইটুকুর জন্যেই বন্ধুকে একবারও বাড়িতে আমন্ত্রণ না করা, ওইটুকুর জন্যেই সহস্র মিথ্যার জাল ফেলা।
এর প্রভাব কাটিয়ে উঠবার শক্তি অর্জন করতে পারে না মীনাক্ষী।
মোড়ের কাছ থেকে সরে এসে দ্রুত পায়ে বাড়ি পর্যন্ত চলে এল মীনাক্ষী। একটু থমকে তার ঠাকুর্দার আমলের এই পুরনো ধরনের বাড়িখানার দিকে চোখ তুলে তাকাল।
দেখল দোতলায় বাবার ঘরে আলো জ্বলছে, খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সে আলো। ঠোঁটটা একটা কামড়াল। এটা দিবাকরের কাছ থেকে শেখা নয়, এটা মীনাক্ষীর নিজস্ব। ছেলেবেলা থেকেই কোনও কিছু অপছন্দ হলে ঠোঁটটা কামড়াত। এখনও রয়ে গেছে অভ্যাসটা।
ঠোঁট কামড়ে ভাবল, আশ্চর্য, একজন পুরুষ মানুষ সারাদিনের কাজের শেষে সন্ধ্যায় একটু খেলাধুলো আমোদ-প্রমোদের ধার ধারে না। একটু বেড়াতে যায় না। স্রেফ বাড়ি বসে থাকে! অথচ দিবাকর
উঠতে বসতে যে কোনও ব্যাপারে দিবাকরের সঙ্গে তুলনা করাই যেন নেশা হয়ে গিয়েছে মীনাক্ষীর। বোধ করি অতুলনীয় দিবাকরকেই তার পুরুষের আদর্শ বলে মনে হয়। তাই দিবাকরের বেপরোয়া রাত এগারোটা বারোটা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর গল্প মনে পড়ে যায় তার বাবাকে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি বসে থাকা দেখে।
নিজের বেপরোয়াপনার অনেক গল্পই করে দিবাকর। বলতে গেলে ওইটিই তার গল্পের উপজীব্য। আমি!আমিকে কেন্দ্র করেই তার যত কথা।
থাকে দিবাকর তার এক বিজনেসম্যান বিরাট বড়লোক মামার বাড়িতে, কারণ নিজেদের বাড়ি তো তাদের দেশের জমিদারিতে। তা মামা নাকি দিবাকরকে শাসন করার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। শাসন করতে এলে দিবাকর মামাকে হাসির তোড়ে উড়িয়ে দেয়। যুগটা যে আর তার মামার আমলে আটকে নেই, সেই পরম সত্য তথ্যটি শুনিয়ে দিয়ে মামাকে ঠাণ্ডা করে দেয়।
বেড়িয়ে বাড়ি ফেরবার সময় একটু রাত হয়ে গেলে যখন ভয়ে বুকটা ছমছম করে, তখন মীনাক্ষীর দিবাকরের সেই নির্ভীক উক্তিগুলো মনে পড়ে গিয়ে নিশ্বাস পড়ে।
যুগটা পালটেছে সে কথা কি মীনাক্ষীই সগর্বে ঘোষণা করে না তার মায়ের কাছে? করে, মায়ের কাছে করে। যথেষ্টই করে। বলে, তুমি তোমার ওই মান্ধাতার আমলের ঠাকুর ঘরেই আবদ্ধ থেকো গে মা, আমাদের চালচলনের মানে আর তোমার বুঝে কাজ নেই।বলে, পৃথিবী গিয়ে চাঁদে উঠছে, আর তোমরা তোমাদের সেই পুরনো খোঁটায় বাঁধা পড়ে থেকে পুরনো কালের জাবর কাটছ।
এমন আরও অনেক কিছুই বলে মীনাক্ষী।
কিন্তু মাকে বলে আর লাভ কি? বাবাকে দেখলেই তো অস্বস্তিতে মন ভরে ওঠে, সিঁড়ির নীচে চটি খুলে রেখে পা টিপে টিপে দোতলায় উঠতে হয়।
এতে যেন নিজের কাছেই নিজে হেয় হয়ে যায় মীনাক্ষী। যেন বাপের মুখের উপর সশব্দ প্রতিবাদে ফেটে পড়তে পারলেই তার অহমিকা পরিতৃপ্ত হতে পারে।
কিন্তু সরোজাক্ষ তাকে সে সুযোগ দেন কই?
সরোজাক্ষ কি কোনওদিন ধমকে উঠে বলেন, এত রাত করে ফিরলে কেন?
বলেন না।
শুধু সরোজাক্ষ, মেয়ে যখন তাঁর দরজার সামনে দিয়ে পার হয়, একবার তাকিয়ে দেখেন। মীনাক্ষী অবশ্য সেই তাকানোর দিকে তাকিয়ে দেখে না, কিন্তু মীনাক্ষী অনুভব করে সেই তাকানোর চোখ দুটোয় অসন্তোষের গভীর কালো ছাপ, সেই চোখ দুটোর উপরকার হৃ দুটো কুঁচকে গিয়ে কাছাকাছি সরে এসেছে।