এ ব্যঙ্গে মীনাক্ষী ক্ষুব্ধ নিশ্বাসে তপ্ত হয়। বলে, কেন বিশ্বাস হবে না? আমার শ্রীযুক্ত দাদার আচার-আচরণ দেখলে খুব বিশ্বাস হবে। রাত দুপুরে বউ নিয়ে পার্টি থেকে ফিরবেন। চোখ লালচে, পা বেঠিক, ইংরেজি ছাড়া বোলচাল নেই মুখে, মার সামনে বউদির কাঁধ ধরছেন পিঠ ঠুকছেন, কে বলবে তবে আমরা অনগ্রসর।
দিবাকর দাসের বাড়ি গণ্ডগ্রামে, ওর বউদিরা এখনও একগলা ঘোমটা দেয়, আর ওর ছোট বোনের শ্বশুরবাড়িতে এখনও দিনের বেলায় বর বউয়ের দেখাসাক্ষাৎটা গর্হিত কর্মের মধ্যে পড়ে, তাই বোধহয় দিবাকরের সমাজচিন্তা এত প্রগতিশীল। তাই সে কথায় কথায় মীনাক্ষীকে সেকেলে বলে নিন্দে করে, ভীরু কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে ব্যঙ্গ করে। বলে,শুধু তোমার গার্জেনদের দোষ দিলে কী হবে, তুমি নিজেও কম কনজারভেটিভ নও। নইলে এতদিনেও একবারের জন্যে একটু সুযোগ জোগাড়ে রাজি করাতে পারলাম না।
মীনাক্ষী আরক্তিম হয়, মীনাক্ষী ঝংকার দেয়,আঃ যতসব অসভ্যতা।
দিবাকর দাস বলে, ওই ওইটিই হচ্ছে বদ্ধমূল কুসংস্কার। যা চিরন্তন সত্য, যা অপরিহার্য অনস্বীকার্য তাকে অস্বীকার করা, তাকে চোখ বুজে এড়িয়ে যাওয়া, তার ওপর অকারণ একটা পাপ মার্কা দেওয়া, এর কোনও মানে হয়?
দিবাকরের ঈষৎ বিস্ফারিত চোখ দুটো যেন আগুনের ঢেলার মতো জ্বলে।
মীনাক্ষীর বুক কাঁপে, মীনাক্ষীর পায়ের নীচের মাটিটা যেন সরে যেতে চায়, মীনাক্ষী তাই কথা পালটায়। বলে,উঃ বাংলা ভাষায় কী দখল! তুমি ইকনমিকসে অনার্স নিতে গেলে কেন, বাংলায় নেওয়া উচিত ছিল।
কথা পালটাচ্ছ? তার মানে ভয় পাচ্ছ!
দিবাকরের মোটা মোটা ঠোঁট দুটো ব্যঙ্গে ঝুলে পড়ে, আশ্চর্য! আশ্চর্য এই মিথ্যে ভয় পাওয়া আর তার জন্যে অনর্থক লোকসান খাওয়া। জীবনের সবচেয়ে দামি দিনগুলো তুমি লোকসান দিচ্ছ।
মীনাক্ষী তবু কথা হালকা করতে চায়, মীনাক্ষী দিবাকর দাসের ধধ করে জ্বলে ওঠা চোখের দিকে তাকায় না, অন্যদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, যতসব বাজে কথা! লোকসান আবার কি? তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আবার লাভ লোকসানের হিসেব!
দিবাকর উত্তেজিত হয়, দিবাকর রূঢ় গলায় বলে,তুচ্ছ? তুচ্ছ যে মোটেই নয় তা কোটি কোটি বছরের পৃথিবীর ইতিহাসই সাক্ষ্য দেবে। লোকান মনে হচ্ছে কিনা তার উত্তর নিজের মধ্যেই পাবে, যদি নিজের দিকে স্পষ্ট করে তাকাবার সাহস থাকে। নেই, সে সাহস নেই! তোমরা মেয়েরা হচ্ছ উটপাখির দল! বালিতে মাথা গুঁজে বসে আছ।
দিবাকর দাসের গায়ের রং কালো, গড়ন বেঁটে আর বলিষ্ঠ ধরনের, ঠোঁট পুরু, নাক মোটা, চওড়া কাঁধ। দিবাকরের মাথার চুল কুচি কুচি করে ছাঁটা, পরনে একটা সাদা ট্রাউজার আর কোমরে চওড়া ইলাস্টিক দেওয়া হাতপুরো ঢিলে ব্লাউজ ধরনের গাঢ় খাকি রঙের কোট। এককথায় সবটা মিলিয়ে কেমন একটা কর্কশ বন্য বন্য ভাব। অন্তত মীনাক্ষীর বাবা, সরোজাক্ষ দেখলে দিবাকর দাসকে একটা বর্বর ছাড়া আর কিছু বলতেন না। কিন্তু মীনাক্ষীর দুরন্ত আকর্ষণ ওই বন্যতার উপর, ওই বর্বরতার প্রতি। পুরুষের কোমল স্নিগ্ধ সৌম্য চেহারা তার পছন্দ নয়। তাই দিদির বরকে দেখলে তার হাসি পায়। অবজ্ঞা আসে। এবং দিদিকে সে কথা বলতেও ছাড়ে না। ঠোঁট উলটে হেসে হেসে বলে, যাই বলিস দিদি, পুরুষ মানুষকে অমন মোলায়েম ভদ্র চেহারা মোটেই মানায় না। একটু বুনো বুনো গোঁয়ার গোঁয়ার না হলে পুরুষ মানুষ অচল।
দিদির ভিতরে কী আছে কে জানে, তবে তর্কে হারতে রাজি হয় না সে। তাই বলে,ঠিক আছে, তোকে একটি নিগ্রো যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে।
মীনাক্ষী হেসে ওঠে।
মীনাক্ষী ঠিক দিবাকরের মতো কাঁধ ঝাঁকায় আর ঠোঁট ওলটায়, বিয়ে দেওয়া হবে? সেই অপেক্ষায় বসে থাকব নাকি তোর মতো?
নিজেই করবি?
নিশ্চয়।
মীনাক্ষীর দিদি যেন ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায় তার অবিবাহিতা ছোট বোনের দিকে। ওর দৃষ্টি দেখলে মনে হয় যেন ওকে ওর প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে মীনাক্ষী সেটা ভোগ করতে চাইছে। তাই হঠাৎ কৌতুকের গলা ছেড়ে কড়া গলায় বলে, তলে তলে চালানো হচ্ছে বুঝি কিছু?
মীনাক্ষী সামলে নেয়, হেসে দিদির গলা ধরে। বলে, রাগলে তোকে কী সাংঘাতিক সুন্দরী দেখায় দিদি।
দিদিকে ওর ভাল লাগে না, সর্বদাই ওর মনে হয়, ছেলেবেলা থেকেই মনে হত, দিদি যেন ওকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখছে। তবু যখন তখন দিদির বাসায় বেড়াতে যেতে হয় মীনাক্ষীকে, না হলে কলেজ শেষে এবং বাড়ি ফেরার সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানটাকে মাঝে মাঝে ম্যানেজ করে নেওয়া শক্ত হয়ে ওঠে।
মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, মীনাক্ষী এ ভয়টুকু করে চলে। ভয় করে বাবার সামনে পড়ে যাবার, তাই মোড়ের কাছ থেকেই ছাড়াছাড়ি করতে হয় দিবাকরের সঙ্গে।…আর দিবাকর দাস চওড়া কাঁধটা ঝাঁকিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হেসে চলে যায়। দিবাকর দাসেদের পরিবারে সেই প্রথম ছেলে যে বি-এ পড়ছে, তাই দিবাকর দাসের মধ্যে যেন একটা বিশ্ব নস্যাৎ ভাব জন্ম নিয়েছে। দিবাকর দাস মনেপ্রাণে আচারে আচরণে অতি প্রগতিশীল হতে চায়, তাই দিবাকর মীনাক্ষীকে চমকে দেবার মতো কথা বলে। বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করে।
দিবাকর তার বন্য বর্বর চেহারাটার জন্যে লজ্জিত তো হয়ই না, বরং সাজসজ্জায় সে চেহারাকে আরও কর্কশ করে তুলতে পছন্দ করে। আর মীনাক্ষীর আকর্ষণও সেই বস্তুটার উপরই। মীনাক্ষী ওই কর্কশ কুৎসিত লোকটার আকর্ষণেই সম্মোহিত।