না, ছেলেকে এসব বোঝতে বসেন না সরোজা। তিনি অন্যমনস্ক বটে, তবে অবোধ নন। এ ধরনের কথা বললে ওরা যদি বলে বসে, বেশ তো, মা রাখুন ওকে। ঠিক সময় খাওয়া শোয়া হবে।
বলতেই পারে। বলবেই নিশ্চয়। সুযোগ পেলেই ছোবল বসাবে। এই মনোভাব নিয়েই থাকে ওরা। কেন থাকে, তা জানেন না। তবে থাকে এটা জানেন। আর এও জানেন, বিজয়া কোনওদিনই স্বামীর কথার মান রাখতে বসবেন না।
বিজয়ার সময় কোথায় নাতি দেখবার?
বিজয়ার নিজের ঘরে ডজনখানেক পোষ্য নেই? বিজয়াকে তাদের খাওয়াতে হয় না? শোয়াতে হয় না? চামর ব্যজন করতে হয় না? তাদের সেই সেবাপর্বের জন্যে সর্বদা বিশুদ্ধবাসা হয়ে থাকতে হয় না? সরোজাক্ষ তো জানেন পৃথিবীর কোনও মহাশক্তিই ওঁকে ওঁর আসন থেকে টলাতে পারবে না। অন্য সর্ববিধ শোভনতা অশোভনতা ওঁর কাছে তুচ্ছ। সরোজাক্ষ অবশ্য বোঝাতে যাবেন না, তবু যদি বোঝাতে চেষ্টা করেন নিশ্চয়ই জানেন বিজয়া পরিষ্কার প্রাঞ্জল ভাষায় বলবেন, রোজ দিদিমার ঘাড়ে চাপানোটা দৃষ্টিকটু তা বুঝি। তবে তারও চেয়ে দৃষ্টিকটু ওই বাচ্চা ছেলেটাকে ভাসিয়ে দিয়ে নিত্য সন্ধেয় মা বাপের ধেই ধেই করে বেড়াতে যাওয়া। তবে? ওরা ওদের ছাগল ল্যাজে কাটবে, আমার কি!
হ্যাঁ, এইরকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হক কথা অধ্যাপক গৃহিণীর।
আগে আগে সরোজাক্ষ স্ত্রীর এই নিরাবরণ হক কথার নিরাবরণতায় মরমে মরে যেতেন। মরমে মরে যেতেন ওঁর গ্রাম্যতায়। ক্রমশ সয়ে গেছে, অথবা সয়ে যায়নি। সয়ে যাবার নয়। শুধু চুপ করে গেছেন।
আগে চেষ্টা করতেন। বিয়ের পর প্রথম প্রথম, সেই অতীতকালে। নববধূর আচার-আচরণ, ভাষা-ভঙ্গি সবকিছুর ওপরই সংস্কারের মার্জনা চালাতে ব্ৰতী হয়েছিলেন। বিজয়া ওঁর সে চেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে। পঞ্চদশী বিজয়া স্বচ্ছন্দে তার অতি মার্জিত অতি সুকুমার রুচি নতুন বিয়ের বরের সামনে খসখস করে গা চুলকোতে চুলকোতে বলেছে, নমস্কার করি বাবা তোমাদের বালিগঞ্জের পায়ে। মশার কামড়ে একেবারে ডুমো ডুমো করে ছাড়ল। এমন ডাঁশ ডাঁশ মশা নিয়ে ঘর করো কী করে তোমরা? গায়ে গণ্ডারের চামড়া নাকি?
সরোজ মরমে মরেছেন।
সরোজাক্ষ বলেছেন, ওভাবে কথা বলছ কেন? ভালভাবে কথা বলতে পারো না?
বিজয়া তার সুন্দর মুখে খিলখিল করে হেসে বলেছে, কথায় আবার ভালমন্দ কি? আমি তো মশাদের গালমন্দ করছি না? রক্তগুলো সব চুষে নিল, বলব না সেটা?
কিন্তু খারাপ গালমন্দই কি মুখে আটকায় বিজয়ার? না আটকাত? তবু তখন মাঝে মাঝেই সব বিরক্তি ছাপিয়ে সুন্দর মুখেরই জয় হত।
হত। কারণ তখন সরোজক্ষর বয়েস পঁচিশের নীচে। সেই বয়েসটার কাছে হার মানতেই হত মাঝে মাঝে। হার মানতে হত বিজয়ার নিখুঁত মুখ আর অনবদ্য গঠনভঙ্গির কাছে। হার মানতে হত তার চাঁপা রঙের দেহবল্লীর কাছে। আর হার মানার পরমুহূর্তেই আসত ধিক্কার। নিজেকে মারতে ইচ্ছে করত। আরও করত, যখন দেখতেন বিজয়া সেই অসহায় আত্মসমর্পণটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে।
ষোড়শী বিজয়া সরোজাক্ষকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার সমবয়সী ননদকে বলত, বেটাছেলে জাতটা হচ্ছে একটা নচ্ছার জাত বুঝলি? বিয়ে হলে টের পাবি। মুখে দেখায় যেন কতই উদাসীন সাধুপুরুষ, বুঝি মেয়েমানুষ জাতটাকেই ঘেন্না…হি হি হি, রাত্তিরের অন্ধকারে বুঝলি? বুঝবি, বিয়ে হলে টের পাবি।
সরোজাক্ষর কান বাঁচিয়ে তো নয়ই, বরং কান লক্ষ্য করেই এ আলোচনা চলত। খেয়াল করত না আলোচনার সঙ্গিনী সরোজাক্ষরই ছোট বোন। দাদা বলে যার সমীহর শেষ নেই। মুখ তুলে কথা বলতে পারে না।
শুনে অপমানে ধিক্কারে কান গরম হয়ে উঠত সরোজাক্ষর, প্রতিজ্ঞা করতেন ইহজীবনে আর নয়। কিন্তু রক্ষা হত না সে প্রতিজ্ঞা। ওই বেহায়া মেয়েটাই আবার গায়ে পড়ে কাছে এসে, অথবা কেঁদেকেটে ফিট করে–
কিন্তু যাক, সে কথা।
সে-জীবনে ইতি পড়ে গেছে।
বিজয়া এই মর্ত্যলোকের মালিন্য থেকে ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। সরোজাক্ষ নীচের তলায় নিজের কাজে। সরোজাক্ষ ওই ঊর্ধ্বগতির কারণ নির্ণয় করতে অক্ষম নন, কিন্তু সরোজাক্ষর তার প্রতিকারের ক্ষমতা নেই।
সরোজাক্ষ তাই ওই পট্টবস্ত্র পরিহিতার সংস্রব থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতেই চেষ্টা করেন। যতটা সম্ভব কম কথা কইতে।
তবু আজ একটু কথা কইলেন।
কিন্তু বিজয়া কি চুপ করে যাবেন?
বিজয়া কি জীবনে কখনও চুপ করে যেতে রাজি হন? হন না। এখনও তা হলেন না। বললেন, হু। স্বামী! মেয়েমানুষ নিজে শক্ত হলে স্বামীর সাধ্যি আছে তাকে বদলাবার?
সরোজাক্ষ ভাবলেন, তা নেই বটে।
কিন্তু সরোজাক্ষ আর কথা বললেন না। সরোজা তোয়ালেটা পেড়ে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলেন। আর ভাবতে লাগলেন, কাল সকালে কোনও খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় সরোজাক্ষর লাঞ্ছনার কাহিনী ঘোষিত হবে না তো?
সরোজাক্ষ দেখতে পেলেন না একজোড়া জ্বলন্ত চোখ নিষ্ফল আক্রোশে তাকিয়ে থেকে থেকে আগুন ছড়িয়ে আবার চলে গেল তার সেই নাসেরে আসা পুজোপাঠের উদ্দেশ্যে।
.
রাস্তার মোড়ে ছাড়াছাড়ি হতে হয়, বাড়ির সামনে পর্যন্ত একসঙ্গে আসার সাহস হয় না। কী জানি কে দেখে ফেলে। এই নিয়ে দিবাকর ব্যঙ্গ হাসি হাসে। বলে, বাস্তবিক কী অদ্ভুত তোমাদের বাড়িটি! বিশ্বাস হয় না তোমরা একটা উচ্চশিক্ষিত পরিবার, তোমার বাবা একজন অধ্যাপক, মেয়েদের কলেজে পড়বার পারমিশান দিয়েছেন, আর এই কলকাতা শহরের আধুনিক সমাজে বাস করছ তোমরা!