কিন্তু ভাঙাটা কি খুব সহজে হয়েছিল? নীলাক্ষকে কি তার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে নিষ্ঠুর হতে হয়নি? যথেষ্ট পরিমাণে কৌশলী? একদিনে তো ভাঙেনি, তিলে তিলে দিনে দিনে। অনেক অনিচ্ছা, অশ্রুপাত, প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে উপেক্ষা করে সেই সাধারণীকে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করল নীলাক্ষ। তারপর?
তারপর এই নতুন মূর্তি।
যা দেখে নীলাক্ষও এখন মাঝে মাঝে ভয় পায়, বিস্মিত হয়।
এখন আর সুনন্দা শুধু নীলাক্ষর প্রয়োজনেই পেটকাটা বুককাটা ব্লাউজ পরে অতি আধুনিকার মার্কা মেরে পার্টিতে যায় না। এখন সে নিজের সংগৃহীত নিমন্ত্রণপত্রে পার্টিতে পার্টিতে ঘুরে বেড়ায়, হি-হি করে হাসে, মিহি করে কথা বলে, আর এমন ভাব দেখায় যেন চিরকালই সে এই জীবনে অভ্যস্ত।
নীলাক্ষ যেখানে বউকে ওর ডিলারদের সঙ্গে শুধু হেসে কথা বলতে বলে, সুনন্দা সেখানে তাদের গা ঘেঁষে বসে উদ্দাম হাসিতে নিজেকে ছেড়ে দেয় তাদের গায়ে।
নীলাক্ষ তার বউকে টোপ করে গভীর জলের রুই কাতলাকে খেলিয়ে তুলতে চেয়েছিল,নীলাক্ষর বউ তার স্বামীকে সে রকম দু-দশটা রুই কাতলা ধরে দিয়ে নিজেই কোন ফাঁকে গভীর জলের মাছ হয়ে গেছে।
ওদের একটা ছেলে আছে, যার ভাল নাম উজ্জ্বলাক্ষ, আর ডাকনাম বিচ্ছু। ছেলেটা আগে প্রাণ ছিল সুনন্দার, এখন যেন অসুবিধের বোঝ। অন্তত তার কথাবার্তায় আর ব্যবহারে তাই যেন মনে হয়। যখন তখনই বলে আর একটা বছর গেলেই বোর্ডিঙে দিয়ে দেব ওটাকে।আর বলে বেশ সরবেই।
সরোজাক্ষ শুনতে পান, কিন্তু ডেকে হেঁকে কোনওদিন সে সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেন না। সমর্থনে কি অসমর্থনে কোনওদিকেইনা। তবু তাঁর যেন মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি সেটাও ভাল। অন্তত ছেলেটা তার বোধের দরজা খোলার পর যেন টের না পায় সে তার মা-বাপের একটা অসুবিধে! সে তার মা বাপের স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার পথে বাধা-স্বরূপ।
কিন্তু কথাটা বিজয়ার কানে পৌঁছলেই তিনি মন্তব্য করে বসেন। বলেন, তা দেবে বইকী বোর্ডিঙে। নইলে বাবা-মার সাহেব হওয়াটা হবে কী করে? একটা মাত্তর ছেলে, সে ছেলেটাকে পাঁচ বছর পার হতে না হতে বাড়িছাড়া করে দেবার কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না? মায়া-দয়া বলে বস্তুটা কি ভগবান তোমাদের শরীরে দেননি?
সুনন্দা, যে সুনন্দা নাকি বিয়ের পর বেশ কয়েকটা বছর শাশুড়ির সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলতে পারত, সে এখন তার খাটো চুলের গুচ্ছ নাচিয়ে অমায়িক গলায় বলে, তা বোধ হয় দেনই নি। তা আপনার যদি মন কেমন করে, আপনিই নিন না ভার। আমার সময় কম, দেখাশোনা করতে পারি না বলেই
বিজয়ার রাগ আছে, তেজ নেই। অহংকার আছে, আত্মসম্মানবোধ নেই। তাই বিজয়া বলেন, হ্যাঁ, আমার তো আর অন্য কাজ নেই। আমি আমার পুজোপাঠ শিকেয় তুলে ওই বিচ্ছু বদমাইশের ভার ঘাড়ে নেব।
তবে আর কী করা! সুনন্দা চোখ নাচিয়ে বলে, তবে ওর কপালে বোর্ডিংই। মা বাপ নিষ্ঠুর। ঠাকুমা বিজি, পিসি উদাসীন, অতএব?
বলে যেন কেটে কেটে, যেন টুকরো বসিয়ে বসিয়ে।
আর বোধ করি দিন গোনে কবে ছেলেটাকে বাড়িছাড়া করবার বয়সে পৌঁছতে পারবে। সুনন্দাকে তার স্বামী নিজে হাতে ধরে যে জীবনে পৌঁছে দিয়েছে, সে জীবনে ওই দুরন্ত শিশুটা নিতান্তই অবান্তর।
আপাতত এখনও বাড়িছাড়া করতে পারেনি, তাই নিজেরা যখন বেরোয়, ছেলেটাকে তার মামার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। আর ফেরার সময় ঘুমে অচৈতন্য ছেলেটাকে উঠিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসে।
দিদিমা খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে–নাতিরমতো করে নয়, গচ্ছিত রাজপুত্রের মতো করে। কারণ জামাইয়ের ভঙ্গিটা স্রেফ রাজোচিত। এই দীনের কুটিরে নিতান্ত দীন শয্যায় যে তার ছেলেকে রেখে যায় সে, সেটা যেন কুটিরবাসীদের প্রতি বিশেষ কৃপা।
তবুও ভদ্রমহিলা মাঝে মাঝে বলেন, আহা, ঘুমিয়ে পড়েছে, থাকুক না হয়, সকালে ওর দাদু দিয়ে আসবেন।
কিন্তু এ অনুরোধের মূল্য দেয় না ওরা। মহিলার নিজের মেয়েই ঝংকার দিয়ে বলে ওঠে, না বাবা, একদিন ওই আহ্লাদেপনার স্বাদটি পেলে আর রক্ষে আছে? রোজ বলবে–মামার বাড়িতেই ঘুমিয়ে থাকি। তার মানেই স্কুলের বারোটা বেজে যাওয়া।
কথাটা অবশ্য সত্যি।
চার বছরের বিচ্ছু আজ প্রায় বছর দুই হল স্কুলে যাচ্ছে। ভোরের স্কুল, তাকে পিটিয়ে পাটিয়ে স্কুলে পাঠানোর জন্যে শেষ রাত থেকে তুমুল শোরগোল শুরু হয়ে যায় বাড়িতে, ঘুম-ঘুম চোখ ছেলেটাও ওই যাওয়াটাকে পণ্ড করবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে। অতএব লড়াই চলে এক পর্ব।
প্রথমে দু-একদিন বলেছিলেন সরোজাক্ষ, এত অল্প বয়স থেকে স্কুলে যাবে? অতটুকু বাচ্চা সবটা ঘুমুতে না পেলে, সকালের খেলাটা খেলতে না পেলে, স্বাস্থ্যটা ঠিক থাকবে? মেজাজও বিগড়ে যায় ওতে।
নীলাক্ষ বলেছিল,নিয়মে স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
আর কিছু বলেননি সরোজা।
ওইটুকুতেই তাঁর মনে হয়েছিল নিজের গণ্ডি অতিক্রম করে ফেলেছেন। ওদের ছেলে, ওরা অবশ্যই তার ভাল-মন্দ বুঝবে। তিনি কি আর বোঝতে বসবেন, নিয়মটা শুধু কোনও একটা সময়ে করলেই হয় না, চব্বিশটা ঘণ্টাকেই তা হলে নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধতে হয়।
একটা দুবছরের শিশুকে ভোরবেলা স্কুলে পাঠাতে হলে, তাকে অন্তত রাত আটটার মধ্যে বিছানায় পাঠাতে হয়। কিন্তু সেদিকে তোমরা চোখ বুজে থাকবে। তোমাদের স্বেচ্ছাবিহারের তালে ওর জীবনটা নিয়ন্ত্রিত। ও সারা সন্ধ্যা ওর দিদিমার কাছে যথেচ্ছ উপদ্রব করবে, যথেচ্ছ আবদার করবে আর যথেচ্ছ সময়ে খেয়ে হয়তো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে যখন নিতান্তই ঘুমে ঢুলে পড়বে, তখন তোমরা ওকে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় নিয়ে আসবে টানতে টানতে, আর ঘণ্টা কয়েক পরেই ওকে নিয়মের শিক্ষা দেখাতে বসবে। ওতে নিয়মও হয় না, স্বাস্থ্যও গড়ে না।