শুনে শুনে সরোজাক্ষর এসব মুখস্থ হয়ে গেছে, কারণ সারদাপ্রদাদের যখনই মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে, তখনই সারদার মুখ থেকে এইসব জ্বালাময়ী বাণী বেরোতে থাকে। এ-জ্বালা নিরোধের একমাত্র ওষুধ নতুন একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলার অনুরোধ।
সরোজা আবার সে অনুরোধ করেন।
সারদা গম্ভীরভাবে বলে, এই চললাম দাদা, টাকা-টাটকি লিখে ফেলাই ভাল।
সেই ভাল।
বলে আবার শুয়ে পড়েন সরোজা।
সারদা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, বই আমাকে দুটো লিখতে হবে দাদা! একটা হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রাচীন যোগশাস্ত্রের তুলনামূলক ব্যাখ্যা, আরআর একটা হচ্ছে আজকের এই অধঃপতিত ভারতবর্ষের
সারদার আবেগে বাধা পড়ল, ওপর সিঁড়ি থেকে বিজয়ার গলা শোনা গেল, এত আড্ডা হচ্ছে কার সঙ্গে ঠাকুরজামাই? শালাবাবু বুঝি এসেছেন?
সেরেছে! বউদি!বলে সারদা ছেলেমানুষের মতো দৌড় দেয়।
বিজয়া দরজায় এসে দাঁড়ান।
সশব্দ স্বগতোক্তি করেন, ছুটে পালানো দেখো। যেন চোর-ছ্যাঁচোড়। তারপর কণ্ঠস্বর ঈষৎ তোলেন, আমার এখনও পুজোপাঠ শেষ হয়নি।
সরোজাক্ষ ইঙ্গিতটা বোঝেন, নিঃশব্দে উঠে দরজার পরদাটা সরিয়ে দিয়ে এসে বসেন। না, শুয়ে পড়েন না আর, বসে থাকেন ঋজু হয়ে।
বিজয়া এক পা রথে, এক পা পথের ভঙ্গিতে দরজায় দাঁড়িয়ে তিক্ত গলায় বলে ওঠেন, রোজ রোজ কীসের এত মিটিং?
সরোজাক্ষ ওই তিক্ত কণ্ঠের উৎসের দিকে একবার তাকান। দেখেন শরীরটা এত অকথ্য অযত্নেও অমলিন। হলুদরঙা কপালটার উপর মস্ত বড় সিঁদুর টিপটা নিত্য দিনের মতোই জ্বলজ্বল করছে। নিত্যদিনের মতোই জ্বলজ্বল করছে গরদ শাড়ির চওড়া লালপাড়টা। গায়ে জামা শেমিজের বালাই না থাকায় ডানদিকের অনাবৃত কাঁধটা দেখা যাচ্ছে, সেই অংশটুকুও সমান জ্বলজ্বলে। শুধু মাংসভারহীন।
ওই জ্বলজ্বলে দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে দেখে হঠাৎ একটা হিংস্র কল্পনা মনে এল শান্তস্বভাব সরোজাক্ষর। সরোজাক্ষ ভাবতে চেষ্টা করলেন বিধবা হলে ওকে কেমন দেখাবে।
মনে মনে ওঁর সর্বাঙ্গ থেকে লাল রং মুছে নিলেন সরোজা, শাড়ির পাড়ের লাল, সিঁদুরের লাল, হাতের শাঁখার লাল। তারপর মনে মনে বললেন, একটা হলদে কাঠের পুতুল দেখাবে, স্রেফ একটা হলদে কাঠের পুতুল। মনে মনে ওঁর রংটা মুছে ফেলতে থাকেন সরোজা।
বিজয়া এই অবকাশে অসহিষ্ণু হলেন, আবার বললেন, ইস্কুল কলেজের মিটিং রাতদুপুর অবধি চলে?
সরোজাক্ষ নির্লিপ্ত গলায় বললেন, মিটিং ছিল না।
মিটিং ছিল না? বিজয়ার তেতো গলা সন্দেহে তীক্ষ্ণ শোনায়, তবে যে নীলু বলল, টেলিফোনে বলেছে মিটিং হচ্ছে।
তা হবে।
তা হবে? চমৎকার! কী নিশ্চিন্দি! বাড়ির লোকের যে দুশ্চিন্তা বলে কিছু থাকতে পারে সেটা বোধ হয় স্মরণে থাকে না?
দুশ্চিন্তা!
সরোজাক্ষ আর একবার ওই লাল প্রহরীদের দিকে তাকালেন। ভাবলেন যমের কি সাধ্য হবে তোমার ওই প্রহরীদের অতিক্রম করে বৈধব্য ঘটাতে পারবে তোমার?
মুখে বললেন, দুশ্চিন্তার কী আছে?
তা তো বটে। বিজয়ার সর্বপ্রকার বাহুল্য মাংসবর্জিত মুখের নিখুঁত কাঠামোখানা আরও কাঠ দেখাল। বিজয়ার কটুকণ্ঠ ধ্বনিত হল, বলাই ভুল হয়েছিল আমার।
সরোজাক্ষ এতক্ষণে উঠে গায়ের জামাটা খুলে আলনায় টাঙিয়ে রাখতে রাখতে বলেন, নীলু বাড়ি আছে?
নীলু? বিজয়া উলটোনো ঠোঁটে অবজ্ঞার ভঙ্গি ফোঁটান, কেন? বাপের বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে? দুশ্চিন্তায়?
সরোজাক্ষ একটু ব্যঙ্গের গলায় বলেন, আশ্চর্য কি! এই তো শুনেছিলাম বাড়ির লোক দুশ্চিন্তায় কাতর।
হুঃ! তা হলে তো তরেই যেতাম! ছেলে টেলিফোনে একবার বাপের খবর নিয়ে কর্তব্য সেরে বেরিয়ে গেলেন, বউও তার সঙ্গে নাচতে নাচতে চলে গেলেন, ব্যস আর কি চাই? সাজের কী ঘটা। পেটকাটা পিঠকাটা একবিঘৎ জামা, হাওয়ার শাড়ি, ঠোঁটে নখে রং, দেখলে মাথা কাটা যায়। ছিলেন তো একখানা ঘরের ভাড়াটের মেয়ে, নম্রতা ভব্যতা সভ্যতার ভেকও ছিল, এখন নিজ মূর্তি ধরেছেন!
বিজয়া মুখ বাঁকালেন।
সরোজাক্ষ ভাবলেন, অন্যায় কথা বলব না, শুধু এই নীতিই কি সভ্য মানুষের শেষ নীতি? অন্যায় কথার প্রতিবাদ না করাটাও কি অন্যায় করারই নামান্তর নয়? অথচ সরোজাক্ষ ওই না বলার নীতিতেই প্রতিষ্ঠিত থেকে নিজেকে সভ্য শিক্ষিত ভেবে স্বস্তিতে থাকেন।
এই দুর্বল নীতিই কি তাঁকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে? প্রথম থেকে কঠোর শাসনের নীতিতে বিশ্বাসী হলে আজকের ইতিহাস অন্য হত? ঘরে এবং বাইরে?–
কিন্তু সরোজাক্ষ কোনওদিন শাসনের পথ ধরেননি, প্রতিবাদেরও নয়। নির্লিপ্ত থাকবার সাধনাটাই অভ্যাস করেছেন।
ভুল করেছেন কি ঠিক করেছেন, সে হিসেব করতে না বসে হঠাৎ অভ্যস্ত সাধনা থেকে চ্যুত হয়ে বলে ওঠেন, মূর্তিটা তিনি নিজে ধরেননি, তাঁর গুণবান স্বামীই তাঁকে নতুন মূর্তিতে গড়ে তুলেছেন।
কথাটা সত্যি।
নীলাক্ষর স্ত্রী সুনন্দা ছিল নেহাতই গেরস্থালি ঘরের মেয়ে। সুনন্দা বাল্যে তার গরিব বাবার সেই একখানা ঘরের সংসারেরও একটি কোণে বসে শিবপুজো করেছে, পুণ্যিপুকুর করেছে। সুনন্দা তরুণী হয়ে উঠেও বারব্রত করতে ভালবাসত। সুনন্দা গুরুজন দেখলে মাথায় কাপড় দিত, আর মাথা হেঁট করত। সুনন্দা পায়ে আলতা পরত, সুনন্দা স্নান করে উঠে সিঁদুর না পরে জল খেত না। সেই সুনন্দাকে ভেঙে গড়েছে নীলাক্ষ।