হয়তো কিছু চাওয়ার আছে আমার কাছে, জীবনের, নইলে ধরা দেবার জন্য কেন এত আগ্রহ?
অনেকদিন রাত্রে একলা বিছানায় শুয়ে আমি ভেবেছি কেন এমন হলোর হঠাৎ কানে বেজেছে কার কণ্ঠস্বর। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে জহু যেন বলছে জাহেদ আমার ছবিটা শেষ করবি না?
চমকে উঠে একদৌড়ে ওখানে গিয়ে দেখি কেউ নেই, হাস্নাহেনার ঝাড়গুলো শুধু হাওয়ায় কাঁপছে।
জহুর ছবি আর শেষ করতে পারিনি, মনের কোণায় স্কেচটুকু শুধু জমা আছে; যেদিন শেষ করতে পারব সেদিন বুঝব শিল্পী হয়েছি। আরও কত কাহিনি! কিছু স্বাভাবিক, কিন্তু বেশির ভাগই আকস্মিক।
আজও তাই হলো। জোবেদা খালার স্বামী যে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন এবং বহুকাল পর ফিরে এসে নিজের ভাঙা ভিটেটার ওপর পড়ে গত বছর মরেছেন তা আমি বলিনি, তবু সে কি প্রতিক্রিয়া! একদম অবিশ্বাস্য। প্রথম যৌবনের সেই একজন সত্যইকি ছিল তার প্রেমপাত্র? যদি ছিল তবে কেন বেছে নিলেন অন্যপথ?
নিজের উর্ধ্বে উঠতে পারাটাই শিল্পী ব্যক্তিত্বের সর্বপ্রথম অঙ্গীকার এবং সে আমারও লক্ষ্য। এখন শেষ দুঃখ শেষ সুখের সামনে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ি না এতেই আমি সন্তুষ্ট।
বসুন্ধরা ছবিটা প্রথম প্রদর্শনেই সমালোচক ও সমঝদারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এতে আমি সুখী। প্রতিষ্ঠা ও যশ শিল্পী মাত্রেরই কাম্য এবং আমিও সেটা চাই। কিন্তু তবু বলতে পারি, ছবিটা হলঘরের এক কোণায় অনাদরে পড়ে থাকলেও খুব দুঃখিত হতাম না। কারণ আমার যা আসল পাওনা, তা পেয়ে গেছি অনেক আগেই। সে হলো। আনন্দ, সৃষ্টির আনন্দ। সে আনন্দ, আনন্দের চেয়ে তীব্র বেদনার চেয়ে গভীর মৃত্যুর চেয়ে অনন্ত এবং তখন আমিই তো নায়ক ছিলাম না? হ্যাঁ তাই, আমি ছিলাম না তখন। আমি ছিলাম ইজেলে সাঁটানো ক্যানভাসের সামনে, রং সাজিয়ে তুলি হাতে, নিঘুম সারারাত; কিন্তু রচনা করেছিল সে আর একজন। বর্ষণ, বৃষ্টি বিদ্যুৎ, ঝটিকার মেঘে আকাশটা ঝিম ধরে ছিল, যখন ভেঙে পড়ল পরিচিত আমিকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। অন্যজন হলো সৃষ্টির সারথি। আমার দেহের অভ্যন্তরেই জেগেছিল সে বিধাতার মতো, অচেনা রহস্যময় আমার হাত দিয়ে ক্যানভাসের ওপর কাজ করে চলে গেছে। তাকে চিনি না, কিন্তু তবু মনে হয় সে-ই তো জেগেছিল রাফেল দা ভিঞ্চি মাইকেল এঞ্জেলার মাঝে, গগাঁ রেনোয়া পিকাসোর আত্মায়?
এজন্যই বুঝি রাতটা অপরূপ হয়ে এসেছিল। আমাদের ছোট ঘরটার জানালার পাশে একটি নারকেল গাছ চিরল-চিরল পাতায় ছাওয়া, শেষ রাত্রে তার ফাঁকে এসে পড়ল হলুদ চাঁদের আলো। দূরে কোথায় যেন গান হচ্ছিল। এমপ্লিফায়ারের সেই সুর তরঙ্গ দমকা হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসছিল। সে যেন এক সুরলোকের অশ্রুতপূর্ব মধুর রাগিণী।
হঠাৎ কেন জানি তুলিটা হাতে নিয়েই একবার উঠলাম। মাঝের কপাটটা ঠেলে চুপি চুপি শোবার কামরায় ঢুকি। হা ছবি ঘুমোচ্ছে তার কোলের কাছে টুলটুল। হাওয়া আর চাঁদ যেন মিতালি পাতিয়েছে। একজন জানালার পর্দা উঠিয়ে ধরে অন্যজন বুলিয়ে যায় মায়াবী হাতের ছোঁয়া আশ্চর্য সুন্দর। মা ও শিশু এই তো বসুন্ধরা, দুঃখে দুর্ভিক্ষে দারিদ্রে ছিন্নভিন্ন কিন্তু তবু মরে না; তার স্নিগ্ধ শান্ত চোখের চাওয়ায় যুদ্ধের শিবির ভেঙে পড়ে। তার খুশির হাতছানিতে দোলে ধান গম ভুট্টার ক্ষেত-সোনালি খামার নদীর তরঙ্গধারা।
আমি তন্ময় হয়ে দেখছি, এত পবিত্র এই দৃশ্য ওর কপালে একটু চুমু খেতেও সাহস হলো না।
প্রশংসিত হয়েছে এবং বাজার অনুযায়ী দামও কম পায়নি, যদিও কাজের দাম বলতে আমি বুঝি অন্য কিছু। কিন্তু তবু কথা থাকে। সমালোচকরা দেখেছেন কমপোজিশন রং আয়তন মাত্রা বিভাগ, বক্তব্য চোখে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস লাগিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এবং তারা ভুল করেন নি। কিন্তু একটি কথা তারা কখনো জানতে পারবেন না, সে হলো এই ছবির জন্মকাহিনি। নিজের উর্ধ্বে যখন উঠি তখন বরং বলি জীবনই নিজেকে প্রকাশ করেছে, আমি নিমিত্ত মাত্র।
লুভ্যর ন্যাশনাল গ্যালারি, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট কোনদিন যেখানেই এই ছবি যাক না কোনদিন এও কেউ জানতে পারবে না যে আমার ছবিই এই ছবির জন্মদাত্রী। কারণ চতুষ্কোণ কাম্বিসের স্থানটুকুর মধ্যে একজন মানবীর মূর্তি প্রকাশ পেয়েছে, মূর্তি হিসেবে সে বিশেষ কিছু নয় এবং অনাগতকালে আমিও থাকব না, ছবিও থাকবে না থাকবে না টুলটুলও। হয়তো থাকবে শুধু এই ছবি যার নাম মাদার আর্থ, বসুন্ধরা, ক্যাটালগে তালিকাবদ্ধ তেইশ নম্বর তৈলচিত্র।
অন্তত এই ছবিটির বেলায় সামান্য সময়ের জন্য হলেও জীবন আমাকে শিল্পী করেছিল। আর ছবিই সেই জীবন।
অথচ যেদিন প্রথম দেখা হলো তখন বুঝতেও পারিনি এই হাবা মেয়েটিই আমাকে নিয়ে যাবে ঝরনার উৎসবের কাছে।
দোকানে রঙের টিউবগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। একজন লোক প্রবেশ করলেন হঠাৎ। ছেঁড়া শার্ট ময়লা পায়জামা, পায়ে টায়ারের স্যাণ্ডেল। গাল আর চোখজোড়া গর্তে ঢুকে গেছে। আ-ছাঁটা চুল ও খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফে বিপর্যস্ত চেহারা।
একটা কাজ পেয়ে গেছি, দুটো রং দিতেই হবে হোসেন সাব, ব্লু আর রেড। বিকেলের মধ্যে কাজটা সেরে সন্ধ্যায় টাকা নিয়ে রাত দশটার আগেই রঙের দামটা দিয়ে যাব। হঠাৎ আমার দিকে নজর পড়তেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমিও ছবি আঁক নাকি হে?