কিন্তু আমি দেখলাম, লোকটি ভয়ানক ধূর্ত আর যতদূর সম্ভব বদমাশ।
দুদিন পরে এসে দাদাকে ডাকতে ডাকতে একেবারে বাড়ির ভেতর চলে এলেন। দাদা ছিলেন না। আমি সরে পড়বার উদ্যোগ করছিলাম। কিন্তু বাসায় লোকজন নেই বুঝতে পেরে–
কথা থামিয়ে ছবি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, আমার শিথিল হাতটার দুটি আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
আমি চিৎকার করতে চেয়েছি, মুখের ওপর জুতো ছুঁড়ে মেরে বাধা দিয়েছি। কিন্তু বেশিক্ষণ পারিনি।
একখণ্ড মেঘ বোধ হয় উঠে এসেছিল, জানালার বাইরেটা আবছায়ায় ঢেকে গেল। আমি সেদিকে চেয়ে থাকি।
সারা বিকেলটা মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদলাম। এও কপালে লেখা ছিল? কাকে বলব কেমন করে বলব? দাদাকে বলা সে কি লজ্জা! বৌদি সবে ঝগড়া করে গেছেন আসবেন না, বাইরের কাউকে তো বলাই যায় না। এক বলা যেত পান্নাকে। কিন্তু সে শহরেই নেই, শ্বশুরবাড়ি। দিন যায় রাত আসে। রাত শেষ হয় আবার দিন আসে, আমি বোবা লাশের মতো চলাফেরা করি। দাদা কিছু বুঝতে পারে না। লোকটাও উধাও হয়ে গেলেন। দাদা একদিন বললেন, কি অদ্ভুত এক হাজার টাকা অগ্রিম নিয়ে জিনিসটা নিলেনই না ভদ্রলোক! আমি সব জানতাম, কিছু বলিনি।
এদিকে কিছুদিন না যেতেই আমার দেহে অজানা পরিবর্তন শুরু হলো। কি লজ্জা! লুকিয়ে লুকিয়ে টক ঝাল পোড়ামাটি খাই। আরও কত কি! নিজেকে নিয়েই আছি।
কিন্তু কতদিন ঢেকে রাখব! এ তো গোপন রাখবার জিনিস নয়। মন লুকিয়ে রাখছে, শরীরের মধ্যে দিন দিন সেই প্রকাশ পাচ্ছে। দাদা একদিন শুধু বললেন, একি ছবি!
একদিন বৌদি এসে আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বিস্ময় কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একি ছবি!
আমি দৌড়ে গিয়ে তার বুকে আশ্রয় নিই। চোখের পানিতে গাল ভেসে গেল। অনেকক্ষণে বললাম, আমাকে বাঁচান বৌদি।
বৌদি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, কিন্তু তোর এ সর্বনাশ কে করল। কিভাবে করল।
ঘরের দরোজা ভেজিয়ে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলাম। বৌদি সব শুনে এতটুকুন হয়ে গেলেন। বললেন, সর্বনাশ হয়েছে রে সর্বনাশ!
কি হবে আমার বৌদি। আমি কি বিষ খাব, না পালিয়ে যাব কোথাও?
বৌদি সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন না, এ সব কিছু নয়। একটা কিছু উপায় বার করতেই হবে।
এরপর যা বললেন, তা শুনে আমার বুকের ভেতরটা ধুধু করতে থাকে। জানি এই একমাত্র পন্থা। কিন্তু তবু মনটা এমন করছে কেন, যে এসেছে তার তো কোনো অপরাধ নেই? সে নিষ্পাপ নিষ্কলুষ। ফুল কলির মধ্যে থাকতেই তাকে ছিঁড়ে পিষে ফেলা। সমাজ আছে, কিন্তু তার চেয়ে বড় বিবেকও তো মরে যায়নি? আসলে বিবেকও নয়, বিন্দু বিন্দু রক্তে যে গড়ে উঠেছে তার প্রতি কেমন একটা দুর্বোধ্য টান। আমি আস্তে বললাম, বৌদি আমি পালিয়ে যাই। কিংবা দূরে কোনো অচেনা শহরে ব্যবস্থা করে। দাও। আমার জীবনটা তো নষ্ট হলো। অন্য একটা জীবন বাঁচুক।
বৌদি কপাল কুঁচকে ভাবলেন কিছুক্ষণ এরপরে বললেন, তা হয় না ছবি। তোর দরদ কেন, সে আমি বুঝি। কিন্তু এদেশে কোনো দামই তার নেই। বরং ওভাবে গেলে পথের কুকুরের মতো মরতে হবে।
বৌদি! আমি লুটিয়ে পড়লাম। গমকে গমকে কান্না আসছে।
তোর কিছু ভাবনা নেই। আমিই সব ব্যবস্থা করছি। বৌদি বললেন, আমার এক বান্ধবী ভালো ডাক্তার। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমি এক্ষুণি যাচ্ছি ওর কাছে।
তিনদিন তিনরাত্রি পর্যন্ত ছোট বাসাটা হত্যা-ষড়যন্ত্রে চকিত হয়ে রইল। এমনিতেই লোকজন আসে কম। পান্না থাকলে সে আসত মাঝে মাঝেই। কিন্তু এখন ভেতর থেকে গেটের চাপানি দেওয়া থাকে। পর জানতে পেরেছি দাদা নাকি তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন এমন দ্রলোক তার এই কাণ্ড। প্রথম বিশ্বাস করতে পারেনি। পরে বুঝতে পেরে ভয়ানক ক্ষেপে গিয়েছিলেন। শহরের বড় বড় হোটেলে আতিপাতি করে খুঁজেছেন; কিন্তু কোথায় পাবেন তাকে? সে সময়েই কোথায় চলে গিয়েছিলেন।
বৌদির সঙ্গে কথা না বললেও দাদা আপন মনে গজরান আর জোগাড়যন্ত্র নিয়ে থাকেন।
সাতদিনে উঠে বসি কিন্তু ভালোমতো চলাফেরার শক্তি অর্জন করতে মাসখানেক লাগল।
আবার নীরবতা। প্যাকেট থেকে তুলে নিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাই। আমার কোনো অনুভূতিই যেন আর নেই। হৃৎপিণ্ডটা শুধু স্বাভাবিক চালে ঢিপঢিপ্ করে চলছে। হৃদয়ের মধ্যে ধোয়াটে বুদবুদের মতো যা উঠছে পড়ছে তা অবয়বহীন, খাপছাড়া এলোমেলো। জীবনের সার্থকতা, ব্যর্থতা-কত প্রশ্নই আজ নতুন করে দেখা দিল। দুদিন আগেও নিজেকে মনে হতো রাজার মতো আর এখন পরাজিত সৈনিক!
সেরে উঠলাম বটে-ছবি আবার মুখ খুলল কিন্তু অদ্ভুত এক খ্যাপামিতে পেয়ে বসল। প্রায় পূর্ণশিশু বিষাক্ত ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু জীবন্ত ছিল না। মায়ের গর্ভে থেকে পড়ে সে কেঁদে ওঠেনি। কিন্তু তবু তাজ্জব একটু একলা থাকলেই শিশুর কান্না শুনতে পেতাম-যেন কাছেই কখনো কুয়োর ধারে কখনো রান্নাঘরে কখনো বারান্দায়। মাঝে মাঝে আকাশের দিকেও। ব্যাকুল হয়ে ছুটে যেতাম কিন্তু গিয়ে খুঁজে দেখতাম কেউ নেই কিছু নেই। তাহলে এ আমার মনের ভুল?
ফিরে এসে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতাম! এক আশ্চর্য পরীক্ষায় ফেললেন আমায় খোদা! এর হাত থেকে কি আমার মুক্তি নেই?
একদিন শুয়ে ছিলাম পাশ ফিরে দেখি আমার কোলের কাছে নাদুস নুদুস একটা। শিশু হাত নেড়ে হাসছে। ধরতে গিয়ে দেখি শূন্যস্থান। দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ে আমি স্বপ্ন। দেখছিলাম।