সুরেশ্বর শুনল। বলল, সংসার কি সুখের?
আমি তো জানি অ-সুখের।
আমিও তাই জানি। দুঃখের সংসার।
জেনেও আপনি সুখী।
না; আমি সুখী নই– সুরেশ্বর আস্তে আস্তে বলল।
আপনি কি দুঃখী।
মানুষ মাত্রেই দুঃখী।
এসব হল তত্ত্বকথা। মিনিংলেস ওয়ার্ডস… অবনী বলল। তার হালকা এবং হাসি-ঠাট্টার ভাবটা নষ্ট হয়ে আসছিল।
সুরেশ্বর বলল, মানুষের নিয়তির কথা যদি ভাবেন তা হলে কি মনে হয় না, দুঃখ বিনা তার পরিণতি নেই? এই বিশ্ব অনেক প্রবল, তার তুলনায় আমাদের কতটুকু সাধ্য! আমরা কত অসহায়!
অবনী যেন সহসা কোনও আবেগ অনুভব করতে শুরু করেছিল, এবং বেদনার মতন লাগছিল তার। বলল, আপনি দুঃখের কিছু জানেন না। বই পড়ে, হাত জোড় করে দুঃখ চেনা যায় না। …আপনি যদি এখন তত্ত্বের বুলি আওড়ান, সংসার দুঃখময় মোহময়-টয় বলেন তবে সেটা অন্য কথা। ওটা ধার্মিক দুঃখ। আমি তো আপনার কোথাও কোনও দুঃখ-টুঃখ আছে বলে দেখি না।
সুরেশ্বর বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হল না। বলল, আপনি দুঃখকে কোথায় চিনেছেন?
কেন, নিজের জীবনেই।
আমিও তো আমার জীবনে সেটা চিনে থাকতে পারি।
না– অবনী মাথা নাড়ল, তার বিশ্বাস হয় না। বলল, ভদ্র সংসারে, সুখ-সাচ্ছল্যের মধ্যে জন্মেছেন মশাই, তরতর করে জীবন কাটিয়েছেন, গায়ে কাঁটা ফোটেনি। আপনি ভাগ্যবান ব্যক্তি…
সুরেশ্বর চোখ তুলে তাকিয়েছিল। অবনীর মুখের ভাব কেমন উত্তেজিত, তিক্ত, এমনকী বিদ্রূপভরা। সুরেশ্বর বলল, সাচ্ছল্যের মধ্যে আমি জন্মেছি, কিন্তু আমাদের সংসারে কোনও কাঁটা ছিল না–এ আপনি কেমন করে জানলেন?
বোঝা যায়। আমার মতন আপনার আঁতুরঘরটা নোংরা ছিল না।
সুরেশ্বর অপলকে দেখল অনীকে। বলল, আমার মা আত্মহত্যা করেছিলেন। সুখের সংসারে কেউ আত্মহত্যা করে?
অবনী কেমন যেন চমকে উঠল। চোখের পাতা পড়ল না। নিস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শেষে অস্ফুট স্বরে বলল, আত্মহত্যা!
সুরেশ্বর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
সামান্য পরে কেমন যেন আত্মসংবরণহীন হয়ে অবনী বলল, আত্মহত্যা তবু ভাল। কিন্তু আমার মা থিয়েটারের নামকরা মেয়ে ছিল। আমার বাবার শ্রাদ্ধের সময় আমি মাথা কামিয়ে নেড়া হয়েছিলাম। যদিও লোকটা আমার বাবা নয়।
সুরেশ্বর হঠাৎ কেমন নিষ্ঠুরের মতন বলল, আমার পিতৃ পরিচয়ও গৌরবের নয়। তাঁর উপপত্নী ছিল, অন্য সন্তান ছিল।
অবনী স্তব্ধ, নির্বাক; নিষ্পলকে সুরেশ্বরকে দেখছিল। মনে হল সুরেশ্বর যেন তাকে বলছে, আপনার আর কী বলার আছে? আরও কোনও দুঃখ দুর্ভাগ্যের কথা?
৭. অবনী যাবার পর
৩১.
অবনী অনেকক্ষণ হল চলে গেছে।
অবনী যাবার পর মালিনী এসেছিল খাবার নিয়ে; খাবার রেখে টুকটাক কয়েকটা কাজ সারল ঘরের, বাইরের দরজা জানলা বন্ধ করল, করে চলে গেল। যাবার সময়ও দেখল সুরেশ্বর চিঠিপত্র লিখছে। বাইরে থেকে দরজাটা নিঃশব্দে টেনে দিয়ে গেল। ভরতু ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছে, এই সময় তার দেশ বাড়িতে ক্ষেতির কিছু কাজ থাকে; ওর ফিরতে ফিরতে সপ্তাহ তিনেক। ভরতু না থাকায় এবং সুরেশ্বরের শরীর খারাপের পর থেকে মালিনীই মোটামুটি সুরেশ্বরের দেখাশোনা করছে। অন্য দিন মালিনী যখন খাবার দিতে আসে, এসে ছোটখাটো কাজকর্মগুলো সারে তখন সুরেশ্বর তার সঙ্গে দু-দশটা কথাবার্তা বলে। সস্নেহে ও সকৌতুকে কখনও আশ্রমের অন্তঃপুরের খবর কী রান্নাবান্না হল, কাকে কী খেতে দেওয়া হচ্ছে, ডাক্তারবাবুদের জন্যে কী ব্যবস্থা হল ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে; কখনও বা রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে বলে–হ্যাঁ রে মালিনী, আমার ঘরের সামনে কুলগাছে এবারে একটাও কুল দেখলাম না, কী ব্যাপার বল তো? কখনও আবার হৈমন্তীর কথা শুধায়। …আজ খাবার রাখতে এসে মালিনী দেখল, দাদা কাজ করছেন। দু-একটা হু-হাঁ ছাড়া কিছুই বললেন না। মুখচোখ গম্ভীর মনে হল; ব্যস্ত দেখাল। আবার এক এক সময় খুবই অন্যমনস্ক মনে হল, যেন কত কী ভাবছেন। খাবার আনতে আজ খানিকটা দেরিও হয়েছিল। মালিনী হাতের কাজ সেরে চলে গেল।
মালিনী চলে যাবার সামান্য পরে সুরেশ্বর লেখা শেষ করে উঠল। রাত্রের দিকেই সাধারণত সুরেশ্বর চিঠিপত্র লেখার কাজটা সেরে রাখে। অবনীকে সামান্য এগিয়ে দিয়ে ফিরে এসে সুরেশ্বর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। কিছু করতে ইচ্ছে করছিল না। মন চঞ্চল হয়েছিল। পরে যেন মনকে সংযত ও স্থির করার জন্যে প্রত্যহের নিয়মমতন প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র লিখতে বসল। দুটো সাধারণ চিঠি এবং পাটনায় উমেশবাবুকে একটা চিঠি লিখল। তারপর উঠল। রাত হয়েছে। এসময় তার খাওয়া-দাওয়া সারা হয়ে যায়।
বাড়ির ভেতরের বারান্দায় হাত ধুতে এসে সুরেশ্বর দেখল, ভেতরে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে, বাতাসে রাত্রের এবং শীতের স্পর্শও অনুভব করা যাচ্ছে, হয়তো রাত হয়ে আসায় হিম পড়ছে, চারপাশ নিস্তব্ধ, গাছের পাতায় কদাচিৎ দীর্ঘশ্বাসের মতন শব্দ উঠছে বাতাসের।
শোবার ঘরে এসে খেতে বসল সুরেশ্বর। মালিনী মাটিতে আসন পেতে, জল গড়িয়ে রেখেছে। জালতির গোল ঢাকনার তলায় খাবার; দুধের বাটিটাও গরম করে রেখে গেছে ঢাকা দিয়ে। খাবার বলতে খান-চারেক পাতলা পাতলা রুটি, বোধহয় মালিনী নিজের হাতেই সেঁকেছে, সেদ্ধ আলু-গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে মাখানো, কড়াইশুটি আর টমেটো দিয়ে তৈরি একটা তরকারি।