একটু গণ্ডগোল আছে, সেরে যাবেন। হৈমন্তী হাতের ব্যাগ খুলে অবনীর বইগুলো বের করে রাখল। তারপর হঠাৎ বলল, বিজলীবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ, বার দুই দেখলাম। বেশ ভাল লাগল।
ব্যাপার কী? অবনী ইচ্ছাকৃত বিস্ময় জানাল, পরিহাস করেই।
কীসের ব্যাপার, কেন?
একে অন্যের এত প্রশংসা করছেন?
উনি বুঝি আমার প্রশংসা করেছেন?
বিজলীবাবু তো তাই বললেন। ভীষণ প্রশংসা…
ও! পরের মুখে ঝাল খেয়ে বলছেন– হৈমন্তী এবার হাসল। তার হাসি থেকে বোঝা গেল সে আগের মানসিক বিরক্তিটুকু ভুলে গেছে।
নিজের মুখে ঝাল খেতে হলে চোখের একটা উপসর্গ দরকার হাসতে হাসতে বলল অবনী। কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে বসল। বসার আগে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে এল।
হৈমন্তী আচমকা বলল, বিজলীবাবুর স্ত্রীকে দেখলে আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে; অবিকল একই ছাঁচের মুখ। হাসি-টাসিগুলোও যেন এক রকম। আমার সেই বন্ধু এখন দিল্লিতে থাকে।
ডাক্তার? অবনী ভয়-ভয় গলা করে বলল।
হ্যাঁ, তবে এমনি ডাক্তারি করে না; সরকারি হেলথ ডিপার্টমেন্টে কীসের একটা চাকরি নিয়েছে। তার স্বামীও ডাক্তার।
অবনী হৈমন্তীর চোখে চোখে চাইল। হয়তো অবনী বোঝবার চেষ্টা করল হৈমন্তীর মনে কোনও রকম নৈরাশ্য আছে কি না। কিছু বোঝা গেল না। অবনী অন্য কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে যেন বিজলীবাবুর স্ত্রীর প্রসঙ্গ আরও একটু বিস্তৃত করল, বিজলীবাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁর প্রথম স্ত্রীর সহোদর বোন।
শুনেছি। ..বড়কেও দেখেছি, সেই যে বিজয়ার পর গিয়েছিলাম। খুব ভারিক্কী, গিন্নি গিন্নি…
ধর্মকর্ম জপতপ নিয়েই থাকেন। সুরেশ-মহারাজের খুব ভক্ত। অবনী শেষ কথাটা যেন কেমন ভেতরের কোনও লোভের বশে বলে ফেলল।
হৈমন্তী কথাটা শুনল কিছু বলল না।
অবনী বসে থেকে থেকে একটা সিগারেট ধরাবার জন্যে হাত দিয়ে প্যাকেট বা দেশলাই পেল না। শোবার ঘরে পড়ে আছে। উঠে দাঁড়াল, সিগারেট আনতে হবে, চায়ের কথা বলতে হবে মহিন্দরকে; জানলার বাইরে যেন হু হু করে একরাশ অন্ধকার এসে গেছে, বাগানের গাছে পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ফিরে কলরব শুরু করেছে।
একটু বসুন, আসছি। অবনী চলে গেল।
হৈমন্তী বসে থাকল। অবনীর এই বসার ঘরে আজকাল তাকে মাঝে মাঝে এসে বসতে হয়, ঘরটা তাই পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। সাদামাটা বেতের সোফাসেট, তুলোর গদি পাতা, কাঠের ছোট সেন্টার টেবল, একপাশে একটা বুক র্যাক, ছোট মতন এক কাঠের সেলফ, তার তলায় কয়েকটা তামা পেতলের মূর্তি-টুর্তি, ওপরে এক ফুলদানি, টেবল ল্যাম্প; দেওয়ালে একটি ক্যালেন্ডার, অবনীর যুবক বয়সের একটা ছবি। এই সজ্জার মধ্যে বাহুল্য নেই, একেবারে শূন্যতাও নয়, যেন কাজ চালিয়ে দেবার মতন করে সাজানো ঘর। ঘরটি বেশ পরিচ্ছন্ন, কোথাও বিশৃঙ্খল হয়ে কিছু নেই। একলা মানুষ, ঘরদোর এলোমেলো হবার কারণ নেই। চাকরবাকররা যেটুকু করে তাই যেন যথেষ্ট।
হৈমন্তী অবনীর বসার ঘর ছাড়া ভেতরের অন্য দুটি ঘরও একদিন দেখেছে। অবনী বাড়ি দেখাবার সময় একদিন দেখিয়েছিল। কোনও ঘরেই সে বাহুল্য বিশেষ শৌখিনতা দেখেনি। শৌখিনতা যেন অবনীর নেই তার সবই সাদামাটা, যেটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত বড় কিছু রাখে না। এই ধরনের মানুষ যা হয়–অফিস নিয়ে পড়ে আছে, কাজকর্ম শেষ হলে যেটুকু সময় সেটুকু শুয়ে বসে বিশ্রাম নিয়ে কাটানো, আলস্যে বসে বসে গোয়েন্দা কাহিনী পড়া, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি দেখা, কী বড়জোর রেডিয়ো খুলে দিয়ে পায়চারি করা।
অবনী ফিরে এল। জামাকাপড় বদলে এসেছে, পরনে গরম ট্রাউজারস, গায়ে পুরো হাতা সোয়েটার, মুখচোখ পরিষ্কার, মাথার চুল আঁচড়ানো। হাতে কিছু বই। হৈমন্তীর কাছে হাতের বইগুলো নামিয়ে দিয়ে বলল, দেখে বেছে নিন, এর দু-একটা আগেও আপনাকে দিয়ে থাকতে পারি।
বাইরে এতক্ষণ সন্ধে হয়ে গেছে, ঘরের আলো এবার ফুটে উঠেছে। হৈমন্তী বই দেখতে লাগল, অবনী মুখোমুখি বসে ট্রাউজারসের পকেট থেকে মোজা বের করে পিঠ নুইয়ে পরে নিতে লাগল। তার আচরণের মধ্যে কোনও রকম সঙ্কোচ ছিল না।
বই দেখতে দেখতে হৈমন্তী বলল, কোথাও বেরোবেন?
আপনার সঙ্গে…।
এ যেন হৈমন্তীর জানা ছিল। সাধারণত সে এলে অবনী তাকে গুরুডিয়ায় পৌঁছে দিয়ে আসে। আজ প্রথম থেকেই হৈমন্তীর কোনও তাড়া ছিল না। অন্যদিন সে এসে পনেরো কুড়ি মিনিট অন্তর ঘড়ি দেখে, বাসের কথা বলে, আজ একবারও ঘড়ি দেখেনি, বাসের কথা বলেনি। তার ইচ্ছে আজ সে দেরি করে ফিরবে, যতটা সম্ভব সে দেরি করতে চায়।
আজ বেশ ঠাণ্ডা– হৈমন্তী বলল, যেন এতটা ঠাণ্ডায় অবনীকে গুরুডিয়া পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সে মনে মনে প্রথমেই মার্জনা চেয়ে নিল।
এ ঠাণ্ডা আমাদের গা-সওয়া, অবনী সোজা হয়ে বসল। আর কদিন পরেই ক্রিসমাস, তখন কয়েকদিন, জানুয়ারির আধাআধি পর্যন্ত ভীষণ ঠাণ্ডা পড়বে। আমার নিজের খুব ভাল লাগে সময়টা।
ক্রিসমাসে গগন আসছে। হৈমন্তী তিনটে বই বেছে অন্য একটা বইয়ে হাত দিল।
চা নিয়ে এল মহিন্দর। চা আর ওমলেট। হৈমন্তী মহিন্দরের সঙ্গে দুটো কথা বলল, এ বাড়িতে তার পরিচয় এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে চাকরবাকরের মধ্যেও কোনও কৌতূহল আর দেখা যায় না। মহিন্দরের বাবার চোখের ছানি হৈমন্তীকে দিয়ে দেখিয়ে এনেছে। ছানি কাটাতে হবে। এখনও একটু দেরি আছে। হৈমন্তী নিজে ছানি কাটবে না, বলেছে ব্যবস্থা করে দেবে।