দেবযানী হাসল, বলল, তুমি না একসময়ে কবিতা লিখতে।
কোথায় আর লিখতুম! চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন। হল না। …আমার সেই কাব্যচর্চার সঙ্গে আজকের এই ঝাপসা দৃশ্যের কোনও যোগাযোগ নেই, দেবীদি। বরং বলতে পারো, যদি কখনও নিজের অজান্তে এরকম কিছু মনে এসেও থাকে আমি নিশ্চয় মহীদাকে বাদ দিয়ে ভেবেছি।
দেবযানী তাকাল। নীলেন্দু হাসছে। তার গলার স্বরে পরিহাস। বারান্দা বেশ কালো হয়ে এসেছে। অন্ধকার হয়ে এল। হাত কয়েক তফাত থাকলে দেবযানী নীলেন্দুর মুখ স্পষ্ট করে দেখতে পেত না।
চা খেতে খেতে দেবযানী বলল, তোমার মহীদাকে তুমি বাদ দিয়ে ভেবেছ, এ আমি বিশ্বাস করি না।
নীলেন্দু পরিহাস করেই বলল, কেন বিশ্বাস করো না। প্রেমে আর যুদ্ধে সবই সম্ভব।
দেবযানী হেসে ফেলে বলল, তোমার প্রেম আমার পক্ষে সহ্য করা মুশকিল।
ঠিক বলেছ দেবীদি, সহ্যশীলা প্রেমিকার বড় অভাব। দুর্লভও বলতে পারো।
কেন, তোমার সেই বিজয়ানা কে যেন? ঠাট্টা করে দেবযানী জিজ্ঞেস করল।
চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নীলেন্দু বলল, আমার দুর্ভাগ্য দেবীদি, সেই বিজয়া এখন দিল্লি-নিবাসী। গত জুন-জুলাই মাসে শ্রাবণ-ট্রাবণ হবে বোধ হয়, বিজয়া যে ভদ্রলোকের করকমল গ্রহণ করল তিনি ভারত সরকারের খাজাঞ্চিখানার বড় পেয়াদা। শুনেছি, লন্ডনের কোনও অর্থশাস্ত্রের তকমা আছে ভদ্রলোকের। বিজয়ার বাবা, বিজয়া নিজেও সাদরে এঁকে গ্রহণ করেছেন। দেখো দেবীদি, মেয়েরা হিসেবনিকেশেই বলল আর ফাটকা বাজারে কোন শেয়ার ধরবে না ছাড়বে এ বিষয়ে বেশ পটু। দু এক জায়গায় অবশ্য বেসামাল হয়ে যায়। যেমন তুমি। তুমি যা করেছ সেটা মেয়েদের সাধারণ ধর্ম নয়, এমন বোকামি চট করে কেউ করে না।
দেবযানী হাসছিল। নীলেন্দু এই রকমই। তার মন খুশি থাকলে কথা বলার ধরনটাই পালটে যায়, রসরসিকতার অভাব ঘটে না। কেন যেন, দেবযানী নিজেকে অনেকটা হালকা অনুভব করল। বোধ হয় সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম কিছুটা স্বস্তি পাবার মতন লাগল।
মহীতোষ আসছে। তার গলা শোনা যাচ্ছিল।
নীলেন্দু বলল, দেবীদি, তোমাদের এখানে কাছাকাছি কোনও দোকানপত্তর বোধ হয় নেই?
মাথা নাড়ল দেবযানী, বলল, রেলফটকের কাছে দিনের দিকে একটা ছোট্ট মুদির দোকান বসে।
মুদিতে হবে না। স্টেশনের দিকে যেতে হবে, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছে। বলে নীলেন্দু তার প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে নিল।
মহীতোষ এসে পড়েছিল।
নীলেন্দু বলল, কোথায় গিয়েছিলে?
কোথাও নয়, কাছেই; কথা বলছিলাম একজনের সঙ্গে, মহীতোষ বলল। তুই একেবারে সেজেগুজে বসে আছিস?
স্টেশনের দিকে যাব একবার, সিগারেট কিনে আনতে হবে, সেই সঙ্গে বেড়ানোও হয়ে যাবে। তা হলে বেরিয়ে পড়। খুব শীত পড়বে আজ। বাইরে যেরকম হাওয়া..।
দেবযানী কেরোসিনের স্টোভ জ্বেলে মহীতোষের চা গরম করে দিচ্ছিল। নীলেন্দু লক্ষ করল। এসব আগে কোনওদিন ভাবা যায়নিঃকত তুচ্ছ ব্যাপারে আগে দেবীদির প্রবল আপত্তি উঠত, ফুটোনো চায়ের রাসায়নিক পরিবর্তন যে মানবশরীরের কত ক্ষতিকর মহীদা তার সম্পর্কে লম্বা বক্তৃতা দিত। এখন কোনও পক্ষের আপত্তি নেই, নীলেন্দু লক্ষ করেও কিছু বলল না।
মহীতোষের চা পেয়ালায় ঢেলে দেবযানী দুধ চিনি মেশাল। বাস্তবিকপক্ষে এখন রান্নাঘরের মধ্যেটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। দেবযানীকে দেখা যায়, কিন্তু চোখমুখ চেনা যায় না, অন্ধকার তার মুখের গড়ন এবং রেখা একেবারেই অস্পষ্ট করে ফেলেছে।
হাত বাড়িয়ে চা নিল মহীতোষ।
নীলেন্দু বলল, মহীদা, আমি দেবীদিকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি।
মহীতোষ কিছু বলার আগেই দেবযানী বলল, আমায় আবার কোথায় টেনে নিয়ে যাবে?
স্টেশন। চলো বেড়িয়ে আসবে।
আমায় কেন অযথা টানছ?
তোমার এখন কোন কাজ? সন্ধে জ্বালাবে না শাঁখ বাজাবে? ঠাট্টা করে বলল নীলেন্দু।
দেবযানী পিড়ি থেকে উঠে দাঁড়াল, বলল, সন্ধে না জ্বালালেও বাতি জ্বালাতে হবে, অন্ধকার হয়ে গেছে।
বাতি জ্বালিয়ে নাও, তারপর যাব।
মহীতোষ দেবযানীর দিকে তাকাল, বলল, যাও, ঘুরে এসো৷
.
শীতের হাওয়া এমন করে শিউরে দেবেনীলেন্দু বোঝেনি। ঝড় নয়, কিন্তু প্রায় ঝড়ের মতনই শনশন করে হাওয়া দিচ্ছিল শীতের। শুকনো, কনকনে হাওয়া। আজ কী তিথি বোঝা মুশকিল, আকাশে কোথাও চাঁদ দেখা যাচ্ছিল না, অজস্র তারা আকাশের কোণে জড়ো করা। সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছিল। ছেলেবেলায় নীলেন্দুর বড়মামা তাকে সপ্তর্ষি, কালপুরুষ চিনতে শিখিয়েছিলেন, সে সব আর মনে নেই নীলেন্দুর। এখন অবশ্য নক্ষত্র অনুসন্ধানেও কোনও উৎসাহ ছিল না তার। শীতের বাতাস এবং চারপাশের কনকনে ঠাণ্ডা সহ্য করতেই শরীরের সমস্ত উদ্যম ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল।
পাশে দেবযানী। দেবযানী অতটা কাতর নয়। মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই পথ হাঁটছিল। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় টর্চ নিয়েছে দেবযানী, হাতে টর্চ।
নীলেন্দু বলল, দেবীদি, এই যদি তোমাদের সন্ধেবেলার ঠাণ্ডা হয়, রাত্রে নিশ্চয় বরফ পড়বে।
দেবযানী হেসে বলল, তোমার ঘরে কাঠকয়লার আগুন দিয়ে দেব।
চিতা সাজিয়ে আমায় ঢুকিয়ে দিলেও আপত্তি নেই, নীলেন্দু হাসল।
দেবযানী বলল, এরপর তো আরও শীত পড়বে।
বলেছিলে তখন…। কী জানি তখন কী হবে?