না, দেবযানী বলল।
তবে?
আচার করে আমাদের বিয়ে হয়নি। …ও কথা এখন থাক–তোমার মহীদা তোমার জন্যে বসে আছে।
.
০৩.
ঘুম ভেঙে জেগে উঠে নীলেন্দু কয়েক মুহূর্ত কিছুই স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারল না। প্রথমে মনে হল, সে কলকাতায় নিজের বাড়িতে তার তেতলার ঘরে শুয়ে আছে। প্রায় শেষরাতের মতন আবছা লাগছিল চারপাশ। পরের মুহূর্তে সে সচেতন হয়ে উঠল; চোখ খুলে জানলার দিকে তাকাল। না, কলকাতা নয়; তার নিজের তেতলার ঘরও নয়; সময়টাও মোটেই শেষরাত বলে মনে হচ্ছে না। বড় বড় হাই তুলল নীলেন্দু চোখ ছলছল করে উঠল ঘুমের আলসে। কাল সারারাত ট্রেনে ঘুম-টুম প্রায় ছিল না; মনও শান্ত থাকার কথা নয়। রাত্রের অনিদ্রা, রেলে চাপার ক্লান্তি, মানসিক অস্থিরতা স্বভাবতই শরীরটাকে ভারী, অলস করে তুলেছিল। তার ওপর মহীদাদের এখানকার কুয়ার জলে দীর্ঘ সময় ধরে স্নান, মাঝারি মোটা চালের ভাত, প্রচুর শাকসবজি এক পেট খেয়ে আলস্য এবং ঘুম যেন সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরেছিল। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে নীলেন্দু, তা ঘণ্টা তিনেক হবে, একেবারে অসাড়ে।
বিছানায় উঠে বসে নীলেন্দু হাই তুলতে তুলতে একটা সিগারেট ধরাল। শীতের দুপুর অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে, বিকেলও বোধ হয় শেষ হয়ে এল। জানলার বাইরে রোদ নেই, ময়লা আলো, ঘরের মধ্যে ছায়া কালচে হয়ে এসেছে। কান পেতেও নীলেন্দু কোথাও কোনও সাড়া শুনতে পেল না; মহীদা কিংবা দেবীদির গলা নেই, নড়াচড়ার শব্দ নেই। এত নিস্তব্ধতায় কেমন যেন মনে হয়। মনে হয়, মহীদারা এ বাড়িতে নেই, ছিল না, নীলেন্দু এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে কোনও স্বপ্ন দেখছে।
আরও একটু বসে থেকে নীলেন্দু উঠল। শীত করছে। তেষ্টাও পাচ্ছিল।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল নীলেন্দু। ভেতরের ঢাকা বারান্দা ফাঁকা। রান্নাঘরের দিকের দরজা বাইরে থেকে ছিটকিনি তোলা, জাফরির দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ। ডান দিকে মহীদার ঘর। মহীদার ঘরের গা লাগানো ঘরটা দেবীদির। এ বাড়ির তিনটে ঘরের ছক যেন কিছুটা খেয়াল মতন তৈরি করা। পুবের দিকের একটা বড় ঘর দু ভাগে ভাগ করলে যেমন হয়–অনেকটা তেমনই। বাইরের বারান্দা ঘেঁষে অপেক্ষাকৃত বড় ঘরটা মহীদার, তার গালাগানো পেছনের ঘরটা দেবীদির। নীলেন্দুর ঘরের গায়ে গায়ে ভেতর বারান্দার দিক ঘেঁষে স্নানের ঘর। রাত্রের ব্যবহারের জন্য কলঘর। বাড়ির বাইরের দিক থেকে স্নানের জল-টল বয়ে আনার জন্যে দরজা আছে, আলো বাতাস ঢোকার অঢেল ব্যবস্থা। স্নান এবং ছোট কলঘরের গায়ে অল্প ফাঁকা জায়গা, তারপর রান্না আর ভাঁড়ার। অর্থাৎ মহীদাদের ঘরের দিকে যতটা জায়গা গিয়েছে, প্রায় ততটা জায়গায় এপাশের এত ব্যবস্থা।
রান্নাঘরের দিকে ছোট কাঠের চৌকিতে জল ছিল খাবার। ছোট কলসি। পাশে মিটসিফের ওপর দু-চারটে খুচরো বাসন। গ্লাস ছিল কাচের। নীলেন্দু নিজেই জল গড়িয়ে খেল। ভীষণ ঠাণ্ডা জল, দাঁত কনকন করে ওঠে।
দেবযানীর ঘরের দিকে এগিয়ে নীলেন্দু ডাকল, দেবীদি।
সাড়া দিল দেবযানী, দিয়ে বাইরে এল।
নীলেন্দু বলল, কী ব্যাপার। তোমাদের কোনও সাড়া শব্দ নেই?
তার কথার কোনও জবাব না দিয়ে দেবযানী বলল, খুব ঘুমোলে।
অলস, ভারী গলায় নীলেন্দু বলল, সাংঘাতিক। রাত্রে আর ঘুমোতে হবে না। …মহীদা কোথায়?
ঘরেই ছিল। একজন দেখা করতে এসেছিল তার সঙ্গে কথা বলতে বাইরে গিয়েছে। আসবে এখুনি।
ভেতর বারান্দার বন্ধ দরজার দিকে তাকাল নীলেন্দু। তাকে একবার বাইরে যেতে হবে। বলল, বিকেলে তোমাদের চা খাওয়া হয় না?
দেবযানী যেন কৌতুকের মুখ করল। কেন?
কী জানি, তোমাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে–ওটাই বোধ হয় বাদ দিয়েছ,নীলেন্দু হাসল। আত্মসংযম করছ হয়তো।
দেবযানী বলল, এখনও অতটা পারিনি। তুমি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ দেখে চা বসাইনি। এবার বসাব।
নীলেন্দু ইশারায় চা বসাতে বলে বারান্দার দরজার দিকে চলে গেল।
রান্নাঘরের দরজা খুলে দেবযানী স্টোভ ধরাতে বসল।
.
হাত মুখ ধুয়ে কাপড় জামা বদলে নীলেন্দু আবার যখন রান্নাঘরের চৌকাঠের সামনে এসে দাঁড়াল তখন স্টোভ নিভে গিয়েছে। দেবযানী চায়ের পেয়ালা সামনে নিয়ে বসেছিল। নীলেন্দুকে দেখে চা ঢালতে লাগল।
মহীদা ফিরেছে?
কই দেখছি না তো?
কোথায় গেল?
কথা বলছে বোধ হয়।
সেই তখন থেকে? …দাও, আমায় দাও নীলেন্দু হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল। বসাবার জায়গা খুঁজল চারপাশ তাকিয়ে। টেবিলের দিক থেকে চেয়ার টেনে আনার ইচ্ছে তার হচ্ছিল না। কাছাকাছি কিছু নেই। রান্নাঘরের মধ্যে উঁচু মতন একটা চৌকি ছিল ছোট। হাত বাড়িয়ে সেটা চাইল। দেবযানী নিজের চা ঢালতে লাগল।
চৌকিতে বসে নীলেন্দু বলল, তুমি আমায় অবাক করে দিয়েছ। যতই দেখছি ততই যেন বোকা হয়ে যাচ্ছি।
তোমরা অল্পতেই অবাক হও।
আমি কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, তোমায় এই ভাবে দেখব, নীলেন্দু হাসিমুখে অথচ সামান্য উচ্ছ্বাসের গলায় বলল, এরকম একটা দৃশ্য ভাবাই যায় না। চারপাশে শীতের সারা বিকেল আলো নেই, ঝাপসা অন্ধকার কালচে হয়ে এসেছে, জাফরি দেওয়া বারান্দার এক অন্ধকার কোণে রান্নাঘরে তুমি বসে আছ। আর চৌকাটের পাশে আমি। কোথাও কোনও মানুষজন নেই, একেবারে চুপচাপ। ব্যাপারটা কেমন বাংলা উপন্যাস বলে মনে হচ্ছে।