খেতে খেতে সাধারণ কথাবার্তা হচ্ছিল: এদিককার শীতের কথা, শাকসবজির কথা, জঙ্গলের কথা, কোথায় কোন পাহাড় আছে তার গল্প, আরও এলোমেলো কিছু কথাবার্তা।
শেষে আশিস উঠল।
দেবযানীও উঠে পড়ল। বোধ হয় আশিসকে কিছু বলবে।
নীলেন্দু কিছুক্ষণ বসে থাকল। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। প্যাকেট দেশলাই ঘরে পড়ে আছে। এ সময় ঘরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। দেবীদি আশিসের সঙ্গে হয়তো ব্যক্তিগত কথা বলছে, নীলেন্দুকে দেখলে কিছু মনে করতে পারে। নীলেন্দুর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, দেবীদি এখন পর্যন্ত তাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। দেবীদির চোখ, তার ব্যবহার, ভাবভঙ্গি স্পষ্টই বলে দিচ্ছে–সে বেশ সন্দিগ্ধ, খানিকটা যেন উতলা, বিভ্রান্ত। এই উতলা ভাবটা দেবীদি চেপে রাখার চেষ্টা করেও পারছে না।
নীলেন্দুর কেমন যেন মজা লাগছিল। কে বলবে, কিছুদিন আগে এই দেবীদির সঙ্গে তার যে ধরনের সম্পর্ক ছিল তাতে এ রকম কোনও আকস্মিক সাক্ষাৎ ঘটে গেলে দেবীদি আহ্লাদে গলে যেত। গলা জড়িয়ে ধরত দু হাতে, মুঠো করে মাথার চুল ধরে টানত, কথা বলত অনর্গল, হাত ধরে টেনে নিয়ে ঘুরে বেড়াত, হুকুম করত, জ্বালাতন করত–অর্থাৎ যে সহজ আন্তরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানুষকে উৎফুল্ল ও আতিশয্যময় করে তোলে দেবীদির আচরণে সেটা দেখা যেত। এই ধরনের ছেলেমানুষি অজস্রবার করেছে দেবীদি, সামান্য কারণেই। কিন্তু এখন তার কোনও লক্ষণই নেই।
টেবিল থেকে উঠে পড়ল নীলেন্দু। ভেতর বারান্দার জাফরির দরজা ভেজানো ছিল। খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। কুয়াতলায় কেউ নেই। দুটো কাক আর কয়েকটা শালিক ওড়াউড়ি করছে। রোদ কড়া হয়ে উঠছিল। পায়ের তলায় কাঁকর মেশানো মাটি, সামান্য ঘাস দুপাশে,শীতে মরে আসছে। একদিকে একটা বড়সড় আতাগাছ।
নীলেন্দু কুয়াতলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ছোট করে বাঁধানো কুয়াতলা। কুয়া দেখল ঝুঁকে। মনে হল, গভীরতা কম নয়; জলে কিছু পাতা পড়ে আছে, বাতাসে উড়ে আসা পাতা। আশিস বোধ হয়ে চলে গেল, দেবীদি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী যেন বলল।
কুয়াতলার পাশ দিয়ে বাড়ির পেছন দিকে আসতেই, ছোটখাটো সবজি ক্ষেত চোখে পড়ল নীলেন্দুর। বাড়ির মধ্যে বাগান, তবু শুকনো কাঠকুটো, কোথাও কোথাও বা কাঁটাগাছের বেড়া। বাড়ির জোয়ান লোকটা বাগানে কাজ করছিল। নীলের বাগান সম্পর্কে কোনও বিশেষ উৎসাহ না থাকলেও বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে শাকসবজি দেখতে লাগল। কিছুই প্রায় বাদ নেই। একপাশে পালং শাক, অন্য দিকে বেগুন, ছোট ছোট কপি হয়ে রয়েছে, সারারাতের ঠাণ্ডা আর হিমে কপির পাতা কেমন সতেজ সাদাটে সবুজ দেখাচ্ছিল। কড়াইশুটির গাছগুলো আশ্চর্য মোলায়েম নরম। সবজি ক্ষেতের গন্ধ উঠছিল।
নীলেন্দু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেবযানীকে দেখতে পেল।
আশিস চলে গেল? নীলেন্দু জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ। …তুমি এখানে?
তোমাদের সবজি বাগান দেখছি।
দেখো। এই বাগান তোমার মহীদার।
মহীদার এই বিদ্যেও জানা ছিল জানতাম না, নীলেন্দু হাসল।
বিদ্যের আর কী– দেবযানী বলল, ও তো সব জানে–ওই লাটু; ক্ষেতখামারের কাজ জানে। ওই সব করে। বলে একটু থামল, তারপর বলল, আমাদের একরকম এতেই চলে যায়।
নীলেন্দু চোখ তুলে দেবযানীকে দেখল। হাটবাজার করতে হয় না?
হয়, কিছু কিছু করতে হয়–; হাট থেকে আলু-টালু আনতে হয়, সামান্য শাকসবজিও। তবু বেশির ভাগটা এখান থেকেই কুলিয়ে যায়।
নীলেন্দু কী মনে করে হেসে বলল, তোমরা দেখছি কৃচ্ছতা সাধনের ব্রত নিয়েছ। দেবযানী যেন প্রথমে কথাটা বোঝেনি; পরে বুঝে বলল, তা বলতে পারো। আমাদের হাতে তো অঢেল পয়সা নেই। যতটা পারি খরচপত্র কমিয়ে চলবার চেষ্টা করি।
নীলেন্দু দেবযানীকে লক্ষ করছিল। আন্তরিকভাবে বলল, তোমার এমন অভ্যেস ছিল না। হাত টেনে কবে চলেছ আমি মনে করতেও পারি না। অভাব, দুঃখ, কায়ক্লেশ সহ্য করার ক্ষমতা তোমার আছে–একথা ভেবে অবাক হচ্ছি।
দেবযানী সামান্য চুপ করে থেকে বলল, অবাক হবার কিছু নেই; আমায় তুমি উড়োনচণ্ডে স্বভাবের কবে দেখলে! ..যাকগে, ধরে নাও অবস্থা আমার স্বভাব বদলেছে।
তাই দেখছি। যাকে কোনওদিন রান্নাঘরের চৌকাটে দাঁড়াতে দেখিনি, তাকে দেখছি পিড়ি পেতে রুটি বেলছে।
দেবাযানী হেসে ফেলল। বলল, এ তোমার বাড়াবাড়ি; মেয়েরা রান্নাঘরের চৌকাট মাড়ায় না– এমন মেয়ে আমাদের দেশে দেখবে না। আগে আমার পিড়ি পেতে বসার দরকার করত না, এখন করে। তা ছাড়া এমন তো কিছু নয়, দুটো ডালভাত সামান্য তরকারি, ওটা না পারলে মেয়েদের লজ্জা রাখার জায়গা থাকে না।
নীলেন্দু কী মনে করে কৌতূহলের সঙ্গে বলল, তোমরা কি মাছ মাংস ছেড়ে দিয়েছ?
খাওয়া হয়ে ওঠে না।
এটা ঠিক জবাব হল না, এড়িয়ে যাওয়া উত্তর হল।
দেবযানী বাগানের লাটুকে কিছু শাকসবজি তুলতে বলে নীলেন্দুর দিকে তাকাল। বলল, এখানে মাংস পাওয়া যায় না; মাছ বলতে নদীর ঘোট ঘোট মাছ; ডিম অবশ্য গাঁয়ে পাওয়া যায়। আমি কোনও কোনওদিন পেলে খাই। ও খায় না।
মহীদা খায় না, তুমি খাও–মানে? সধবার আচার নাকি?
দেবযানী কেমন বিব্রত বোধ করল। তুমি যদি তাই ভাব, তবে তাই। কিন্তু এমন আচার কেউ আমায় পালন করতে বলেনি।
নীলেন্দু খুব আচমকা জিজ্ঞেস করল, তোমরা কোথায় গিয়ে বিয়ে করেছিলে দেবীদি? কালীঘাটে?