নীলেন্দু আচমকা বলল, আমি কেন এসেছি জান?
না।
আন্দাজ করতে পারছ না?
তুই তো বলেছিস নিজের ইচ্ছেয় এসেছিস।
মাথা নেড়ে নীলেন্দু বলল, হ্যাঁ, আমি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি। আমায় কেউ পাঠায়নি। কেউ জানে না আমি তোমাদের কাছে আসছি।
তা হলে আমার ভাববার…
দাঁড়াও, আমার কথা শেষ করতে দাও। আমি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি মানে এই নয় যে তুমি এতটা নিশ্চিন্ত থাকতে পার। এমনও তো হতে পারে, তোমার সঙ্গে আমি একটা বোঝাপড়া করতে এসেছি। নীলেন্দু স্পষ্ট ও সামান্য জেদি চোখে মহীতোষের দিকে তাকিয়ে থাকল।
মহীতোষ একটু যেন ভাবল। তারপর বলল, তোর একার সঙ্গে যদি বোঝাপড়া করার কিছু থাকে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। অন্য কারও সঙ্গে বোঝাপড়ার কিছু নেই আমার। তুই ভুলে যাস না, আমি শুভঙ্করদের সকলের সামনেই আমার যা বলার বলে এসেছি। কলকাতা থেকে আমি পালিয়ে আসিনি; চলে এসেছি। আমার খবরাখবর তোদের জানানোর কোনও দরকার ছিল না বলে জানাইনি। তা ছাড়া দেবী চাইত না আমাদের খবর কাউকে দি। শুভঙ্করদের কাছে আমার কৈফিয়ত দেবার কিছু ছিল না, আজও নেই। ওদের সঙ্গে আমার বোঝাপড়ার কথা ওঠে না।
নীলেন্দু মহীতোষকে দেখতে থাকল। এই প্রথম মহীতোষকে সামান্য বিরক্ত দেখাল। বিরক্ত এবং কিছুটা কঠিনও। নীলেন্দু আরও বেশি দেখেছে: সে জানে মহীদা প্রয়োজনে কত বেশি রূঢ়, জেদি, তিক্ত, নিষ্ঠুর হতে পারে। মানুষের চরিত্রের প্রতিটি খুঁটিনাটি জানা সম্ভব নয়, কিন্তু দীর্ঘদিনের অন্তরঙ্গতায় নীলেন্দু মহীতোষের চরিত্রের অনেকটাই জানে, তার দুঃসাহস এবং দুর্বলতাও। যে-কোনও কারণেই হোক মহীতোষের এই ঈষৎ রূঢ়তা নীলের ভাল লাগল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নীলেন্দু বলল, বেশ, বোঝাপড়াটা তোমার আমার মধ্যেই হবে।
মহীতোষ এমন করে মাথা হেলাল যাতে মনে হল তার কোনও আপত্তি নেই।
অনেকক্ষণ একই ভাবে রোদে বসে থাকতে থাকতে গরম লাগছিল নীলেন্দুর। পুলওভারটা খুলে ফেলল। কুয়াতলায় আশিসের স্নান হয়ে গেছে। সকালের দিকে বারান্দার পুব ঘেঁষে রোদ নেমেছিল অল্প, এখন অর্ধেক বারান্দাই রোদে ভরা। মাটি ক্রমশই উষ্ণ হয়ে উঠছে। বাতাসে বিন্দুমাত্র আর্দ্রতা নেই। সবই কেমন স্বচ্ছ, উজ্জ্বল।
দেবযানী বারান্দায় এল। দেখল।
পেয়ারাতলার কাছাকাছি বারান্দার ধারে এসে নীলেন্দুকে বলল, তুমি হাত মুখ ধবে না? এসো। মুখচোখ ধুয়ে একটু কিছু খেয়ে নাও।
মহীতোষেরও যেন হঠাৎ খেয়াল হল, বলল, তাই তো নীলু, তোর তো সকালে মুখ ধোওয়াই হয়নি। ওঠ। জামাটামা ছাড়। হাতমুখ ধুয়ে নে। কুয়োর জলে খুব ফ্রেশ লাগবে।
নীলেন্দু তার পুলওভারটা কাঁধের ওপর ফেলল; পিঠ নুইয়ে জুতো মোজা তুলে নিল বাঁ হাতে, ঠাট্টা করে বলল, দেখি কতটা লাগে?
.
হাতমুখ ধুয়ে নীলেন্দু ভেতর বারান্দায় এসে বসল। প্যান্ট ছেড়ে পাজামা পরেছে। গায়ে হাফ হাতা সোয়েটার।
দেবযানী সকালের জলখাবার এনে দিল। লাল আটার রুটি উনুন থেকে সদ্য তোলা; বেগুন আর কড়াইশুটির তরকারি।
নীলেন্দু খেতে খেতে বলল, বাঃ, তোমাদের এখানে রান্নার তো বেশ স্বাদ আছে।
দেবযানী দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, শাকসবজিরও খুব স্বাদ।
মাথা নেড়ে স্বীকার করে নীলেন্দু বলল, তা তো হবেই; মাটির গুণ। আমি একবার রাঁচির দিকে শীতকালে মাসখানেক ছিলাম। শীতের শাকসবজি যে খেতে কত সুস্বাদু হয় তখনই বুঝেছি।
দেবযানী বলল, এসব আমাদের বাগানের।
চোখ তুলল নীলেন্দু। তোমাদের বাগানের?
দেবযানী বলল, কুয়োতলার ওপাশটা তুমি দেখোনি, তোমার মহীদা ছোটখাটো সবজি ক্ষেত করেছে।
বাড়ির চারপাশ নীলেন্দুর এখনও দেখা হয়ে ওঠেনি, পরে সবই সে দেখে নেবে। কিন্তু মহীদা সমস্ত কিছু ছেড়েছুঁড়ে এসে এখানে এক টুকরো সবজি ক্ষেত নিয়ে বসে আছে ভাবতেই তার হাসি পাচ্ছিল।
দেবযানী বলল, তুমি খাও, আমি চা নিয়ে আসি।
রান্নার দিকে যাবার আগে দেবযানী ভেতর ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আশিসকে ডাকল। আশিসের সময় হয়ে আসছে গাড়ির, জলখাবার খেয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হবে।
আশিস এল! প্রথমে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল, তারপর নিচু গলায় কীসের কথাবার্তা সেরে নীলেন্দুর দিকে টেবিলের সামনে এগিয়ে এল।
.
নীলেন্দু সহাস্য চোখে আশিসকে দেখল। কোনও কোনও মানুষকে প্রথম নজরেই মোটামুটি আঁচ করা যায়। নীলেন্দু যেন আশিসকে আগেই আঁচ করে ফেলেছিল। বেশি রকম লাজুক, বয়েসে সাবালক হলেও মনে এখনও ঠিক সাবালক হয়ে ওঠেনি; নরম চেহারা, স্বভাবও নরম গোছের; চোখের দিকে তাকালে বেশ বোঝা যায় সংসারের অনেক কিছুর সঙ্গে তার পরিচয় ঘনিষ্ঠ নয়।
আশিস বসল।
নীলেন্দু আলাপ করার ভঙ্গিতে বলল, দশটায় গাড়ি?
আশিস মাথা নাড়ল আস্তে করে।
কতক্ষণ লাগে ঝাড়গ্রাম যেতে?
মিনিট চল্লিশ।
ঝাড়গ্রাম শুনেছি ভাল জায়গা। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ট্রেনিং কলেজ অনেক কিছু আছে।
আশিস যেন একটু খুশি হল।
আপনি কী করেন, ভাই? নীলেন্দু জিজ্ঞেস করল।
কোর্টে চাকরি করি। ক্লার্ক।
ও! ..বাড়ি ওখানেই?
মাথা হেলিয়ে আশিস বলল, হ্যাঁ ঝাড়গ্রামেই তাদের বাড়ি।
ততক্ষণে দেবযানী এসেছে। এক হাতে আশিসের জলখাবার, অন্য হাতে নীলেন্দুর জন্যে চা। টেবিলের ওপর খাবার চা নামিয়ে দিয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেল, ফিরে এল জলের গ্লাস নিয়ে। আশিসের জন্যে চা নিয়েও এসেছে।