নীলেন্দু আয়াস করে বসে সিগারেট ধরাল। তারপর কী মনে করে মহীতোষের দিকে তাকিয়ে হেসে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল।
মহীতোষও হাসল। মাথা নাড়ল।
সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ? নীলেন্দু ঠাট্টার গলায় বলল।
হ্যাঁ। অনেক দিন।
কেন? সাধু সন্ন্যাসীদের অনেকেই তো বিড়ি সিগারেট গাঁজা আফিং খায়।
আমি তো সাধু সন্ন্যাসী নই।
বাঃ, নীলেন্দু মজার গলায় শব্দ করল। তুমি তো ওই লাইনে এসেছ। …একটা সিগারেট খেতে দোষ কী! একসময়ে পর পর খেতে।
দোষ কিছুই নেই; আমি ছেড়ে দিয়েছি।
কেন? ক্যানসারের ভয়ে?
না মহীতোষ ঘাড় নাড়ল। নিজের জন্যে খরচ কমিয়েছি।
আচ্ছা, তা হলে খরচের কথা ভাবছ– নীলেন্দু পরিহাস করেই বলল।
মহীতোষ একটু চুপ করে থেকে বলল, না ভাবলে চলবে কেন? এখানে আমার আয় কী বল? খাওয়া পরা চালাবার মতন ব্যবস্থাটুকু আগে করতে হবে, বাকিতে আমার কী প্রয়োজন?
নীলেন্দু বড় বড় টান দিল সিগারেটে, মহীতোষের চোখ ভাল করে লক্ষ করতে করতে বলল, মহীদা, তুমি আমার কাছে খোলাখুলি কটা কথা বলবে?
কেন বলব না?
বেশ, তা হলে সত্যি সত্যি বলল, এই বাড়ি কি দেবীদি নিজের টাকায় কিনেছে?
হ্যাঁ।
টাকা পেল কোথায়? গয়নাগাটি বেচেছে?
মহীতোষ স্বীকার করল, দেবাযানী গয়নাগাটি বেচেছে। আমি দেবীকে বারণ করেছিলাম; আমার ততটা ইচ্ছে ছিল না। ভেবেছিলাম পরে কিনলেই হবে। দেবী জিদ করে কিনে ফেলল। লাভের মধ্যে এই হল, ওর অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল।
নীলেন্দু যেন মনে মনে হিসেব কষে বলল, দেবীদির বাড়ির হিসেব মতন যত গয়নাগাটি পাথর-টাথর নিয়ে চলে এসেছে দেবীদি তাতে আমার মনে হয় বাড়ি কেনার পরও বেশ কিছু থাকার কথা। তাই না?
কিছু আছে, মহীতোষ অস্বীকার করল না, বলল, আমি সব খবর রাখি না, তবে দেবী কিছু সঞ্চয় রেখেছে। এখানকার ছোট পোস্ট অফিসে রাখতে হয় পেটের জন্যে, বাকিটা ঝাড়গ্রামে ব্যাঙ্কে। রেখেছে।
নীলেন্দু সামান্য অবাক হচ্ছিল। এত খোলাখুলি কথা মহীদা বলবে সে ভাবেনি। একটা সময় মহীতোষের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক ছিল যে ধরনের ঘনিষ্ঠতা তাতে মহীদা তার কাছে কোনও কিছুই গোপন রাখত না। সে সম্পর্ক এখনও থাকবে এমন কথা নয়। এবং না থাকারই কথা। মহীদার কাছে গোপনতাই এখন প্রত্যাশা করা যায়। বিশেষ করে এই টাকা পয়সার কথায়–যে টাকাপয়সা তার নিজের নয়, দেবীদির। দেবীদির অনুগ্রহে মহীদার দিন কাটছে–এই কথাই স্বীকার করতে তার সঙ্কোচ হওয়া স্বাভাবিক ছিল। মহীদা কিন্তু অসঙ্কোচ।
নীলেন্দু অন্যমনস্কভাবে সিগারেট শেষ করতে লাগল। তারপর আচমকা বলল, তোমারও তো কিছু থাকার কথা।
মহীতোষ পেয়ারাগাছের মাথার দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, বলল,আমি বাড়িতে ভাইকে লিখেছি। বাবার সম্পত্তির কোনও কিছুই আমি চাইনি, শুধু পুরনো বাড়ির আমার দিকের অংশটা বেচে দিতে বলেছি। ইচ্ছে করলে পরিতোষ নিজেই কিনে নিতে পারে। না হলে বেচে দিক। বেচে দেবার কোনও অসুবিধাই নেই। …আমার কিছু টাকা দরকার, নীলু; এখানে আমি একটা কাজ করব ভেবে রেখেছি।
নীলেন্দু চুপ করে থাকল। সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল ছুঁড়ে। আশিস একবার বারান্দায় এসেছিল। এখন তাকে কুয়াতলার দিকে দেখা যাচ্ছে। কোমরে গামছা জড়ানো, হাতে একটা সাদা লুঙ্গি, বোধ হয় স্নান করতে এসেছে। দশটার গাড়ি ধরবে।
রোদে বসে থাকতে থাকতে সামান্য রুক্ষ লাগছিল। ধুলোর কোনও গন্ধ নেই। অন্য ধরনের টাটকা গন্ধ লাগছিল নাকে। গাঁদা ফুলের ঝোপ রোদে বেশ উজ্জ্বল। আকাশের অনেক উঁচুতে চিল-টিল উড়ছে।
হাই তুলল নীলেন্দু শব্দ করে, দু হাত মাথার ওপর তুলে, দুপাশে ছড়িয়ে আলস্য ভাঙল। তারপর বলল, আমায় হঠাৎ এখানে দেখে তুমি কী ভাবছ, মহীদা?
মহীতোষ কোনও জবাব না দিয়ে শান্ত চোখে নীলেন্দুকে দেখতে লাগল। তার চোখ দেখে বোঝা যায় না, কী ভাবছে মহীতোষ।
আমার প্রায়ই মনে হত, তুই একদিন আসবি, মহীতোষ বলল। দেবীকে আমি বলতাম।
তোমার কেন মনে হত?
মহীতোষ সরলভাবে বলল, কেন মনে হত তুই নিজেই জানিস।
দেবীদি আমায় দেখে খুশি হয়নি। ভয় পেয়েছে।
ঠিক তোকে দেখে দেবীর অসুখী হবার কথা নয়। তুই দেবীর ঘনিষ্ঠ, অন্তরঙ্গ। ও অন্যদের কথা ভেবে ভয় পাচ্ছে হয়তো। মহীতোষ নীলেন্দুর চোখের দিকে এমন করে তাকাল যেন এই সহজ ব্যাপারটা নীলেন্দুর না বোঝার কথা নয়।
নীলেন্দু চুপচাপ থাকল। মহীদার কথায় আপত্তি করার বিশেষ কিছু নেই। তবু তার মনে হচ্ছিল, দেবীদি পুরোপুরি নীলেন্দুকে বিশ্বাস করেনি। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে বিশ্বাস করাও কঠিন। নীলেন্দুও আশা করেনি দেবীদি তাকে দেখে দু হাত বাড়িয়ে টেনে নেবে।
খানিকটা অপেক্ষা করার পর নীলেন্দু বলল, মহীদা, তোমার কী মনে হচ্ছে?
কীসের?
এই যে আমি হঠাৎ ধূমকেতুর মতন তোমাদের কাছে হাজির হলাম…
মহীতোষ দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি তো আগেই বলেছি, আমার মন বলছিল–তুই একদিন এসে পড়বি।
তোমার মন কী বলছিল সে কথা পরে হবে; আমি এভাবে এসে পড়ায় সন্দেহ হচ্ছে না?
নীলেন্দুর চোখে চোখে তাকিয়ে মহীতোষ বলল, খানিকটা হচ্ছে।
কিন্তু তুমি তো বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে রয়েছ। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, একেবারেই ঘাবড়াওনি?
মহীতোষ হাসির মুখ করল। বলল, তোকে দেখে অন্তত ঘাবড়াইনি?