অবশ্য তুমি জানো, সুযোগ খোঁজার মন আমার ছিলনা তখন। আমি অন্য নেশার টানে পড়েছিলুম। সত্যি দেবীদি, তোমার কাছে মিথ্যে বলব না, চারদিকের অবস্থা দেখে দেখে আমার ঘেন্না করে গিয়েছিল। মানুষ কী নিয়ে বাঁচবে বলল, কোন আশ্বাস নিয়ে? আমাদের দেশের চেহারাটা আকারে যত বড় তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তত ক্ষীণ, তুমি কি কখনও প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনও কোনও বিচিত্র জীবের চেহারা দেখেছ? আমি একটা ছবি দেখেছিলুম, বিশাল চেহারার একটা অদ্ভুত ধরনের জীব, অস্বাভাবিক দীর্ঘতা এবং বীভৎসতা ছাড়া তার চেহারায় কোনও প্রত্যঙ্গই পুষ্ট নয়। আমাদের দেশের চেহারাটা ওই রকম। তার আকার অতি বৃহৎ আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত, কিন্তু তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একেবারেই অপরিপুষ্ট। কে জানে প্রাগৈতিহাসিক সেই বিশাল জীবদের মতন এই বিরাটকার দেশ ভবিষ্যতে কোনওদিন অদৃশ্য হয়ে যাবে কিনা। যাই হোক, অত ভবিষ্যৎ ভেবে লাভ নেই। বর্তমানকেই দেখা যাক। আমাদের এই বর্তমান কি গৌরবের? এর মধ্যে কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরই কি স্বাভাবিকতা আছে, সুস্থতা আছে? তুমি অস্বীকার করতে পারবেনা আমাদের মজ্জায় এখন যার ক্রিয়া চলছে সেটা বিষের। ক্ষমতার বিষ, আধিপত্যের বিষ, লোভের বিষ–কোনটা নেই? দুর্নীতি, প্রবঞ্চনা, অত্যাচার, নির্যাতনের ষোলোকলা পূর্ণ করে আমাদের শাসকরা বসে আছে। এদের কে সরাবে? কার সাধ্য?
তোমার কাছে নতুন করে বলার কিছুই নেই, দেবীদি। আমি যতই বোকা হই, একথাটা বুঝতে পেরেছিলাম, হাত জোড় করে বসে থেকে কিছু হবে না। শুধু আমি নয়, আমরা। তুমি তো বোকা নও, তুমিই বলো–যদি কেউ মোটামুটি সুখে শান্তিতে থাকে তা হলে কি সে অকারণ আজ অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইবে? তুমি কলকাতা শহরের মেয়ে, আমি জন্মকাল থেকেই এই শহরে মানুষ। এই কলকাতা শহরটাই কি তোমার চোখে যথেষ্ট নয়? এই শহরের রাস্তাঘাট, মানুষ, মিছিল, ট্রাম, বাস, স্কুল কলেজ, হাসপাতাল, ছেলেমেয়ে…সবই কি তোমায় বলে দেয় নাকী নোংরা, কী বীভৎস ভাবে আমরা বেঁচে আছি। একদিন তুমি সন্ধেবেলায় আউটরাম ঘাটে বেড়াতে বেড়াতে চারদিকের ঝলমলে অবস্থা দেখে আমায় বলেছিলে-কলকাতা শহরটা কি ওরা কিনে নিয়েছে? ..কথাটা ঠিকই। কলকাতা শহরের দশ আনাই এখন ওরা কিনে নিয়েছে। কলকাতার ভালটুকু ওদের কেনা–! কেন কিনবে না? প্রাচুর্য আর অর্থ, শাসন আর সরকার সবই তো ওদের হাতে। কোটি কোটি কালো টাকা কি সৎপথে জমছে? সেই টাকায় ওরা এই শহর ধীরে ধীরে কিনে নিচ্ছে আর আমরা ঘরবাড়ি বেচে, শহর থেকে শহরতলিতে ছিটকে পড়ছি। এই বণিক রাজত্ব, যা ভোগ এবং ভোগ্য সব কিছু কুক্ষিগত করে রাখে তা আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছে এ তোমারও অজানা নয়।
এই ব্যবস্থা, এই অন্যায়, অত্যাচার ও অমানবিকতা সহ্য করা যায় না। অন্তত আমরা পারিনি। লক্ষ লক্ষ ছেলে একটা মোটামুটি কাজ পায় না যেখানে, যেখানে এক বা দুজনের আয়ের ওপর দশ জনে বসে খায়, যে দেশে ভেজাল তৈরির কারখানা বসে যায়, ময়দার সঙ্গে মেশাবার জন্যে বাইরে থেকে পাথরের মিহি গুঁড়ো আসে, ওষুধের নামে কাদার গুঁড়ো না হয় গঙ্গার জল চলে–সেদেশে আমরা শুধু সহ্যই করব, এ কেমন করে হয় দেবীদি?
এই অসহ্যতাই আমাদের পাগল করে তুলেছিল। আমরা কোনও কিছুই আর বিশ্বাস করতে চাইনি, কোনও কিছুর ওপর আস্থা রাখতে রাজি হইনি। যা-কিছু পুরনো–এতকাল যা মাথায় বসে আমাদের চুল মুঠো করে ধরে ডানে বাঁয়ে ঘুরিয়েছে–আমরা তাকে মাথা থেকে ফেলে দেবার চেষ্টা করেছি। ব্যক্তিগত কথা এটা নয় দেবীদি, সেভাবে তুমি দেখো না। আমার বাবা, আমার কাকা ঘরে ঘরে নেই। মহীদার বাবা কী ছিল তুমি জানো। তোমার দাদারা কেমন ধরনের মানুষ তুমি জানো। সোজা কথাটা এই, এমন একটা অবস্থার জন্যে কে দায়ি? আমরা কি? যারা কয়েক পুরুষ ধরে আমাদের এই পথে টেনে এনেছে তারা দায়ি। জন্মের কোনও দায়িত্ব থাকে না, জীবনের থাকে। জীবনকে যারা লালন করে তাদের থাকে। সে দায়িত্ব আমাদের জন্যে কেউ পালন করেনি। তার ভোগ ভুগতে হবে বইকী!
এত কথা লিখেও আমার শান্তি হচ্ছে না। ভাই দেবীদি, তুমি আমার একটা কথা বিশ্বাস কোরো। আমি বিদ্রোহ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রক্তপাত করতে নয়। মহীদা একটা জিনিস ভুল করেছে। আমরা সবাই উন্মাদ হবার দিকে পা বাড়াইনি। অনেক ছেলে ছিল যারা সত্যি সত্যিই চেয়েছিল–এই পুরনো, জগদ্দল কাঠামো ভেঙে দিতে। তারা আশা করেছিল কলের পুতুল ভেঙে এমন কিছু এনে বসাবে যা জীবনকে মূল্য দেবে। মহীদা একথাটা বোঝেনি।
এবার চিঠি শেষ করি। তোমাদের ওপর আর আমার কোনও ঘৃণা নেই, রাগ নেই। কেন নেই জানো? বাস্তবিক পক্ষে আমি যা তোমরাও তাই, দু তরফই নিষ্ক্রিয়, অক্ষম। আমি বরাবর আড়ালে আড়ালে থেকে গিয়েছি, যারা আড়ালে থাকে তারা কোনও ভূমিকা পালন করে না। মহীদাও সেই আড়ালের মানুষ। আমিও। আমরা কোনও কিছুই করতে পারিনি। আর আজ মনে হয়, পারার দিন শেষ হয়ে গেল।
বুলবুলকে পাঠিয়ে মনে হচ্ছে, সে হয়তো একটা সান্ত্বনা পেতেও পারে। অবশ্য যদি মহীদা তার নতুন কাজকর্ম থেকে আবার না পালিয়ে যায়। আমি চাই, মহীদা যা করতে চেয়েছে তা যেন করতে পারে। তোমায় একদিন বলেছিলুম, সে হয়তো আবার পালাবে। আজ বলছি তুমি তাকে পালাতে দিয়ো না। তাকে বলল, যে কাজ সে করতে নেমেছে–যার জন্যে তুমি সবই দিয়েছ, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছ–সেকাজ তাকে করতেই হবে। বার বার ছল করে পালিয়ে গিয়ে সে বাঁচবে না। তুমি আমার প্রণাম নিয়ো। প্রণামে ক্ষতি কী!
ইতি
—তোমার নীলু।