নীলেন্দুর সেই কিট ব্যাগ, বৃষ্টির জলে ভিজে যাবার ভয়ে বুলবুল চিঠিটা কিট ব্যাগের মধ্যে রেখেছিল, ব্যাগ খুলে চিঠিটা বের করে দিল।
মহীতোষ চিঠিটা নিল। খামে মোড়া চিঠি। ওপরে লেখা দেবীদি।
মহীতোষ দেবযানীকে ডাকল।
দেবযানীর আসতে দেরি দেখে মহীতোষ বুলবুলকে বলল, তুমি ভেতরে চলো, জামাটামা ছেড়ে ফেলো। এখানে আজ গোটা হপ্তাটাই খুব বৃষ্টি হচ্ছে।
ঘরে ঢোকার মুখেই দেবযানীর সঙ্গে দেখা। মহীতোষ চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, নীলুর চিঠি। এই ছেলেটি কলকাতা থেকে আসছে।
দেবীযানী চিঠি নিল। বুলবুলকে দেখল ভাল করে। রোগা চেহারা, বয়েস বড় কম, মাথাভর্তি ভেজা চুল, মুখ যেন মাছের আঁশের মতন ফ্যাকাশে।
মহীতোষ বলল, ও আগে জামাটামা ছেড়ে নিক, সকালবেলায় এমন ভিজল
দেবযানী বুলবুলকে জিজ্ঞেস করল, নীলু কেমন আছে?
ভাল।
ওর বাড়ির খবর জান?
ভাল– বুলবুল বড় আড়ষ্ট বোধ করছিল।
মহীতোষ বলল, ওসব পরে হবে, আগে ভেজা জামা প্যান্ট ছেড়ে নাও।
দেবযানী আর দাঁড়াল না, চলে গেল।
গায়ের জামাটা খুলতে খুলতে বুলবুল বলল, বাথরুমে গিয়ে সব ছেড়ে আসি? ঘরের মধ্যে জল পড়ছে।
এসো5; এদিকে বাথরুম।
বুলবুল কিট ব্যাগ খুলে শুকনো জামা-টামা বের করে নিতে লাগল।
.
রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে দেবযানী নিজের ঘরে বসে নীলেন্দুর চিঠি পড়তে লাগল: দেবীদি,
সবার আগে তোমার–তোমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আমার একটি অন্যায় কাজের কথা জানাচ্ছি। যে-ছেলেটির হাত দিয়ে এই চিঠি পাঠাচ্ছি সে আমার চেনা। বুলবুল খুবই ছেলেমানুষ, তার না আছে শারীরিক সামর্থ্য না মানসিক ক্ষমতা, সে তোমাদের কোনও ক্ষতির কারণ হবে না। তার কাছ থেকেই ওর সব কথা শুনতে পাবে। মিথ্যে কথা বলবে না, কেননা বলে কোনও লাভ নেই। ছেলেটি বড় বিপন্ন। তুমি তাকে আশ্রয় দেবে এই বিশ্বাসে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। মহীদাকেও আমি যতটা চিনি, আমার বিশ্বাস, সেও বুলবুলকে কিছুদিনের জন্যে রেখে নিতে অরাজি হবে না।
এবার অন্য কথায় আসি। তোমার চিঠি পেয়েছি। প্রথমে ভেবেছিলাম অবজ্ঞা করব। শেষে পারিনি। পরিতোষের কাছে গিয়েছিলাম। কথা বলেছি। সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান, সাংসারিক জ্ঞানগম্যি তার রয়েছে। মহীদাদের পুরনো বাড়ির দিকটা বস্তি ফস্তি উঠে, কিছু বাড়ি ভেঙেচুরে নতুন রাস্তাঘাট আরও যেন কী কী হতে যাচ্ছে। ফলে ওই বাড়ির পজিশন ভাল হয়ে যাচ্ছে, জমির দামও যাচ্ছে বেড়ে। এখন ওই বাড়ি বেচলে যা আসবে, দু-তিন বছর অপেক্ষা করে বেচলে তার ডবল আসতে পারে। পরিতোষ তাই গড়িমসি করছিল। তা ছাড়া সে বলছিল যে, তার দাদার এই খেয়াল মিটে যাবার পর তোমরা শূন্যহস্ত হয়ে পড়বে–তখন তোমাদের কী থাকবে? তোমার শ্বশুরবাড়ির দু-একটা ঘরে মাথা গোঁজার জায়গা ছাড়া আর কিছু থাকবে না, ভবিষ্যৎ ফাঁকা। এসব হল সংসারী পরিতোষের কথা। সে মহীদাকে চিঠি দেবে। আপাতত সামান্য কিছু টাকাও পাঠাতে পারে। …এই ব্যাপারে আমার আর কিছু করার নেই।
দেবীদি, খুব জরুরি কথাগুলো শেষ করে এখন তোমায় অজরুরি কিছু কথা বলি। আমার বাবা অসুস্থ তোমাদের ওখান থেকে ফিরে এসেই এক-একটি পারিবারিক ঝঞ্জাট নিয়ে ছিলাম। শুভেন্দু অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে ছিল, তারপর হল বাবার হার্ট অ্যাটাক। বাবার এখন যাবার পালা। মেজকাকা বড় সরল ভালমানুষ ব্যবসা চালাবার ক্ষমতা তাঁর নেই, ছোটকাকা নিজের ওকালতির বাইরের মাথা খেলাতে চায় না, পারেও না। শুভেন্দু নিজের কাজকর্ম নিয়ে ছোটাছুটি করছে। আমাদের সংসারে যে একটা দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছে এটা আমি বুঝতে পারছি। অনেক যত্ন করে, স্বার্থকে ঘাড়ে চাপতে না দিয়ে, ভাইদের দুপাশে রেখে বাবা যে সংসার গড়ে তুলেছিলেন তার ভাঙা, ছন্নছাড়া টুকরো টুকরো চেহারা বাবা দেখতে চান না। কাকারাও নয়। কিন্তু একে সামলে রাখার যোগ্যতা আমাদের নেই। কাজেই কী যে হবে আমি বুঝতে পারছি না। এই থেকেই আমার মনে হচ্ছে, একজন যা চায়, যা তার সাধ্য অনেকের তেমন ইচ্ছে থাকলেও তাদের সাধ্যে তা কুলোয় না।
তোমায় কটা কথা লিখি। আমার বয়েস এমন কিছু কম নয়, তোমার কান ধরলেও সেটা ক্ষমা করা যেতে পারে। তবে মেয়েরা শুনি একটা বয়েসের দাগ পেরুলে জোয়ারের জলের মতন বাড়ে, তাদের মাথার ঘিলু দেখতে দেখতে ক্ষীর হয়ে ওঠে; সেদিক থেকে তুমি হয়তো আমার মাথার চুলের ঝুঁটি টেনে বলতে পারো–আমি জ্ঞানহীন। সে অধিকার আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। স্বীকার করে নিয়েও পরের কথাগুলো লিখছি।
দেবীদি, যখন নিজেকে নিয়ে ভাবি, আজকাল থেকে থেকেই এই ভাবনা হয়, তখন কেমন যেন মনমরা হয়ে যাই। আমার জীবনের বারো আনাই তোমার জানা। নতুন করে বলার মানে হয় না। তবু বলি, যে চার আনা তুমি জানো না, তার কথাও তোমায় আজ বলতে ইচ্ছে করে। …সংসারে এক-আধজন থেকে যায় যার কাছে নিজের সমস্ত কিছু কোনওনা-কোনও সময়ে বলতে ইচ্ছে করে। মহীদা আমার কাছের মানুষ, কিন্তু তোমার চেয়ে কাছের নয়, তুমি আমার সুখদুঃখের মধ্যে জড়িয়ে আছ।
তোমায় বলতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই যে, আজকাল মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, তোমায় কি আমি তেমন করেই ভালবেসেছিলাম যেমন করে একজন পুরুষ একজন রমণীকে ভালবাসে? যদি তা না হবে তবে কেন তোমায় বুকের মধ্যে অনুভব করি, কেন এক একদিন মনে হয়–তোমায় বিয়ে করে ঘরসংসার করতে পারলে ক্ষতি কিছু হত না। হয়তো, তখন যখন আমরা পরস্পরের দর্শন ছাড়া বাঁচতে পারতাম না, যখন তুমি আমার কপালে তোমার গাল ছুঁইয়ে আদর করতে তখন যদি আমি তোমায় বলতাম,দেবীদি, তুমি আমার বউ হবে? –হয়তো তুমি রাজি হয়ে যেতে। মহীদা তখন ছিল । যখন সে এল তার পরও আমার সুযোগ ছিল। হায় হায়, সে সুযোগ আমার হারিয়ে গেল।