.
আরও খানিকটা বেলায় নীলেন্দু কোথায় বেরিয়ে গেল। বুলবুলকে বলল, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসব।
বুলবুল ঘরেই থাকল।
ঘণ্টাখানেক পরে ফিরল নীলেন্দু। হাতে একটা প্যাকেট। বুলবুলের হাতে দিয়ে বলল, ওই প্যাকেটের মধ্যে তোর জন্যে একটা প্যান্ট আর জামা এনেছি, একটা পাজামা রয়েছে, সব আন্দাজে কিনেছি। দেখে নে।
বুলবুল-প্যাকেটটা খুলল। প্যান্ট, জামা, পাজামা শুধু নয়, দুটো গেঞ্জি, একটা খদ্দরের পাঞ্জাবিও রয়েছে।
বুলবুল কেমন সঙ্কুচিত হয়ে বলল, এত জিনিস তুমি কিনে আনলে?
তোর তো কিছু নেই। সস্তায় কিনেছি। যেখানে যাবি সেখানে কিছু পাবি না। তা ছাড়া একটু সাজ পালটে যা গাধা, রেলে যাবি…
বুলবুল মুখ ঘুরিয়ে নিল, তার ভীষণ কান্না আসছিল।
নীলেন্দু কী মনে করে বলল, আমার একটা ব্যাঙ্ক আছে, বুঝলি। ছোটকাকা আমার ব্যাঙ্ক। চাইলে ও বিশ-পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দেয়। এবার একটু বেশি নিয়েছি। তোর গাড়িভাড়াও রয়েছে। …
বুলবুল বাঁ হাতে চোখ মুছল।
নীলেন্দু দেখতে পেয়েছিল, হেসে বলল, শোন বুলবুল, তোকে একটা কথা বলি। আমার ছোটকাকা উকিল মানুষ, মক্কেলদের পয়সায় রিচ ম্যান। এই একশো দেড়শো টাকায় তার যায় আসে না। …কাকা আমায় ভীষণ ভালবাসে। …তুই ওসব ভাবিস না।
বুলবুল মুখ ফেরাল না।
.
দুপুরের দিকে বৃষ্টি নামল। নীলেন্দু ঘুমোচ্ছিল। বুলবুল বসে বসে একটা গল্পের বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল। বৃষ্টি নেমেছে দেখে বুলবুলের ভয় হল, এই বৃষ্টি যদি এইভাবে চলে তা হলে সে কেমন করে হাওড়ায় পৌঁছবে? কলকাতায় বৃষ্টি এখন যেভাবে নেমেছে এভাবেই ঘণ্টাখানেক চললে রাস্তায় যে জল দাঁড়াবে তাতে সন্দেহ নেই।
নীলের মাথার দিকে জলের ঝাঁপটা আসতেই তার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে তাকাতেই দেখল, টেবিলের কাছে বুলবুল বসে আছে, বসে বসে ওপাশের জানলা দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে।
নীলেন্দু মাথার দিকে জানলা বন্ধ করল।
শব্দ শুনে তাকাল বুলবুল। নীলুদা উঠে বসে জানলা বন্ধ করছে। বুলবুল বলল, বেশ বৃষ্টি হচ্ছে… নীলেন্দু বলল, তুই ঠায় বসে আছিস? একটু ঘুমিয়ে নিলে পারতিস। রাত্তিরে ট্রেনে শুতে পারবি না; ভিড় হয় খুব। বলতে বলতে হাই তুলল।
আর শুল না নীলেন্দু। বসে থাকল। ইশারায় বুলবুলকে টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই দিতে বলল।
বুলবুল সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই এনে দিয়ে বলল, ট্রেন কটায়?
সাড়ে-আটটা নাগাদ গেলেই চলবে।
অপেক্ষা করে বুলবুল বলল, তুমি কার কাছে আমায় পাঠাচ্ছ নীলুদা?
নীলেন্দু সিগারেটের ধোঁয়া গিলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকল। মুখ দেখছিল বুলবুলের।
তুই চিনবি না,নীলেন্দু সামান্য পরে বলল।
বুলবুল সন্তুষ্ট হল না। তার কৌতূহল যে সারাদিনে কত তীব্র হয়েছে নীলের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। কোথায় যাচ্ছে বুলবুল, কার কাছে যাচ্ছে–এটুকু অন্তত তার জানা উচিত।
বুলবুলের চোখ দেখতে দেখতে নীলেন্দু বলল, তোর ভয় করছে?
মাথা নাড়ল বুলবুল, না…। তুমি যখন পাঠাচ্ছ জেনেশুনেই পাঠাচ্ছ। তবু কোথায় যাচ্ছি জানতে ইচ্ছে করছে।
কী মনে করে নীলেন্দু বলল, বোস।
বুলবুল নীলের পাশে বসল।
নীলেন্দু কিছুক্ষণ কোনও কথা বলল না। সিগারেট খেতে লাগল। শেষে বলল, তোকে যার কাছে পাঠাচ্ছি সে আমার বন্ধু বা বান্ধবী যা মনে হয় বলতে পারিস। তার স্বামীও আমার বন্ধু। আমি তাকে দাদা বলি। একসময়ে আমাদের সঙ্গে খুব মেলামেশা ছিল। এই কলকাতাতেই থাকত। তারপর হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে দুজনেই বাইরে চলে গেল। বাইরে গিয়ে চাষ-ফাস করছে, তাঁতকল-টল চালাবার চেষ্টায় রয়েছে। ..লোক ভাল, তোর ভয়ের কোনও কারণ নেই। …তবু একটা কথা তোকে বলে দি। যদি দেখিস তারা তোকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে আমায় লিখবি, কোনও গণ্ডগোল করবি না, আমি অন্য ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।
বুলবুল জিজ্ঞেস করল, চাষ-ফাস করার চেষ্টা করছে কেন?
ওরাই জানে। ..তুই ওখানে গেলেই জানতে পারবি সব। …গিয়ে দেখ নাকী বলে ওরা…নীলেন্দু হালকা ভাবে হাসল, কত রকমের মানুষ থাকে রে জগতে, এক একজনের এক-এক খেয়াল। তোর ভালও লেগে যেতে পারে।
বুলবুল সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গেল, তারপর বলল, জানো নীলুদা, আমাদের দেশ নানুরে, আমার দাদামশাই ক্ষেত-টেত নিয়ে থাকত আর হোমিওপ্যাথি করত। ছেলেবেলায় আমি অনেকবার নানুরে গিয়েছি, ধানের গোলা দেখেছি…
নীলেন্দু জোরে হেসে উঠল।
বুলবুল অপ্রস্তুত হয়ে চুপ করে গেল।
নীলেন্দু হাসতে হাসতে বলল, কলকাতার ছেলে দেশের বাড়িতে গিয়ে ধানের গোলা দেখেছিস এই তো যথেষ্ট রে। কত ছেলে ধানগাছ না দেখেই গ্রামে বিপ্লব করতে গেল। গিয়ে সাপের ভয়ে ভূতের ভয়ে পালিয়ে এল! …দূরআমাদের দিয়ে কিছু হবে না।
বুলবুল ব্যাপারটা ভাল বুঝল না।
চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে বুলবুল আচমকা বলল, নীলুদা, এরপর কী হবে?
কীসের?
আমাদের কথা বলছি…
তোদের মানে তোর, মানু-টানুর?
হ্যাঁ, আমাদের সকলের।
নীলেন্দু নীরব।
অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নীলেন্দু বলল, আমি জানি না।
.
১১.
তখন বৃষ্টি পড়ছিল। পাতলা বৃষ্টি। ভেজা চেহারা নিয়ে বুলবুল মহীতোষদের বাড়িতে এসে উঠল।
বাড়িতেই ছিল মহীতোষ, লাটু দেখতে পেয়েছিল বুলবুলকে, ডেকে দিল।
মহীতোষ কিছু বলার আগেই বুলবুল তার পরিচয় দিল, বলল, আমি নীলুদার কাছ থেকে আসছি। একটা চিঠি দিয়েছেন তিনি।