নীলেন্দু সবই শুনত, ভাবত, বুঝতে পারত না। তার মনে হয়েছিল দেবীদি অনেকদিন ধরে মহীদাকে এই বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে থেকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, বোধ হয় দেবীদিই যা চাইছিল তাতে সফল হয়েছে।
নীলেন্দুর এটা ভাল লাগেনি। ভাল লাগেনি এই জন্যে যে, মহীদা শুধু নিজেকে হাস্যাস্পদ করেনি, তার আরও কয়েক জন বন্ধু ও অনুগতকে বিশ্রী অবস্থায় ফেলে গেছে। যারা নরেনবাবুদের কাজকর্ম পছন্দ করত না তারা প্রায় অক্ষম হয়ে গেল।
দেখতে দেখতে আবার সব পালটে গেল। যারা চারদিকে আতঙ্ক আর উদ্বেগ সৃষ্টি করে বেড়াচ্ছিল তারা খুন হল, জেলে গেল, অসংখ্য ছেলে দল পালটে ফেলল, পাড়ায় পাড়ায় নির্বিচার ধরপাকড় উইচ হান্ট, এক-একটা পাড়ায় তো রীতিমতো রক্তগঙ্গা বয়ে গেল।
তা হলে?
নীলেন্দু আজ বেশ বুঝতে পারে, কিছুই হল না। খড়ের আগুনের মতন যা জ্বলে উঠেছিল তা নিবে গিয়েছে। এখন শুধু ছাই উড়ছে। কোথাও কোথাও পোড়া খড়ের তলা দিয়ে কিছু উত্তাপ।
নীলেন্দু বুঝতে পারে না, এই রকমই কি হওয়া স্বাভাবিক ছিল, নাকি যা হয়েছে তা নিজেদের অদূরদর্শিতা অপরিষ্কার ধারণা ও জেদের জন্যেই হয়েছে? এই ভুলের মাশুল কে গুনছে? কারা?
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে বুলবুল দেখল নীলেন্দু টেবিলের সামনে পিঠ নুইয়ে বসে বসে কী লিখছে। উঠে বসে বুলবুল বলল, কী করছ?
চিঠি লিখছি।
বুলবুল জানলার দিকে তাকাল। সকাল হয়েছে, কিন্তু রোদ ওঠেনি, হয়তো মেঘলা হয়ে আছে আকাশ। কতটা বেলা হয়েছে বোঝা মুশকিল।
বুলবুল বলল, কটা বেজেছে নীলুদা?
ছটা হবে। …তুই নীচে চলে যা–একেবারে নীচে, বাইরের কলে মুখ ধুয়ে আয়, ঘরের ওদিক দেখ–পেস্ট আছে।
বুলবুল উঠে পড়ে বিছানাটা গুটিয়ে নিল।
তুমি কী ঠিক করলে?
আজ রাত্রে তোকে এক জায়গায় পাঠিয়ে দেব।
কোথায়?
তা এখন জেনে তোর লাভ নেই।
বুলবুল আর কিছু বলল না। ঘরের মধ্যে সামান্য পায়চারি করল, ছাদে গেল, আবার ঘুরে এসে বলল, নীচে সকলে জেগে উঠেছে।
তোকে তো বললাম একেবারে নীচে নেমে যাবি। বাইরে একটা কল আছে…।
বুলুবুল খুঁজেপেতে একটু পেস্ট নিল আঙুলে, তারপর চলে গেল।
নীলেন্দু চিঠিটা শেষ করতে লাগল।
বুলবুল মুখ ধুয়ে এল, নীলেন্দু চিঠি লিখছে তখনও; নীচে থেকে চা দিয়ে গেল মায়ানীলেন্দু তখনও লিখছে, চারমিনার সিগারেটের ডাঁই জমে গেছে মাটির ছাইদানে। আরও খানিকটা পরে নীলেন্দুর চিঠি লেখা শেষ হল।
চিঠি শেষ করে নীলেন্দু দু হাত মাথার ওপর তুলে ক্লান্তি ভাঙল।
বুলবুল বললে, কাকে চিঠি লিখলে?
আমার এক বন্ধুকে। এই চিঠি নিয়ে তুই যাবি। ..
বুলবুল কী যেন জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না।
চিঠিটা গুছিয়ে রেখে নীলেন্দু উঠে পড়ল। সারারাত ঘুম হয়নি, বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করেছে, ভোররাতে আর থাকতে না পেরে উঠে বসে দেবযানীকে চিঠি লিখছিল। এখন বড় ক্লান্ত লাগছে।
বিছানায় এসে গা ছড়িয়ে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকল নীলেন্দু।
বুলবুল?
উ…!
তোর বাড়িতে কে কে আছে?
বাবা, মা, মেজদি, আর আমার ছোট দুই ভাই।
তোর বাবা কোথায় যেন চাকরি করেন।
ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ে; মেজদি হাসপাতালে…
নীলেন্দু বুলবুলের পারিবারিক খবর বেশি জানত না, শুনেছিল একেবারে সাধারণ বাঙালি সংসার। কী করে যে বুলবুল দলে ভিড়ে গিয়েছিল তাও নীলেন্দুর জানা ছিল না। হয়তো বন্ধুদের দেখে শুনে, হয়তো নেহাতই উত্তেজনার বশে, বা এমনও হতে পারে তার কোনও বন্ধু তাকে টেনে নিয়েছিল।
আরও একটু শুয়ে থেকে নীলেন্দু উঠল। বলল, আমি নীচে যাচ্ছি, সকালেই স্নানটা সেরে আসি, শরীরটা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে, তুই বোস।
পাজামা, গেঞ্জি খুঁজে নিয়ে তোয়ালে কাঁধে চাপিয়ে নীলেন্দু ঘর ছেড়ে চলে গেল।
বুলবুল কিছুক্ষণ জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল, চুপচাপ। তারপর কী খেয়াল হল, নীলেন্দুর সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে নিল। সিগারেটের নেশা তার নেই, কখনও সখনও একটা আধটা খায়।
সিগারেট খেতে খেতে বুলবুল বিজুর কথা ভাবতে লাগল। এতক্ষণে নিশ্চয় বিজুর মৃতদেহ মর্গে চলে গিয়েছে, পুরো চব্বিশ ঘন্টা হয়ে গেল, পুলিশ বাড়ি তল্লাসি সেরে ফেলেছে নিশ্চয়, বাড়ির কোথায় কী পেয়েছে কে জানে বোধ হয় বুলবুলদের ব্যাপারটা জেনেও ফেলেছে, কে জানে, পুলিশ বুলবুলদের বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়েছে কি না! পুলিশকে বিশ্বাস নেই, বাড়িতে গিয়ে হয়তো বলবে, বুলবুলরা তিন বন্ধু মিলে আর এক বন্ধুকে খুন করে পালিয়ে গেছে। এরকম কথা শুনলে বাড়িতে যে কী কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে বুলবুল অনুমান করতে পারছে।
বিজু তাদের সর্বনাশ করে গেল। এখন বুলবুলদের কপালে কী আছে এক ভগবানই জানেন। এমনিতে ধরা পড়লে মারধোর জেল হতে পারত, কিন্তু খুনের মামলায় জড়িয়ে দিলে কী হবে কে জানে! আর পুলিশ কী না পারে। তার অসাধ্য কাজ নেই। তবে বিজু যে আত্মহত্যা করেছে–এটা তো পোস্টমটম রিপোর্টেই পাওয়া যাবে। তখন বুলবুলরা খুনের আসামী হবেনা। কিন্তু শালা বড় সাংঘাতিক জিনিস, আত্মহত্যাকে খুনের মামলায় চালিয়ে দেবেনা এটা কে বলল? নীলুদা অবশ্য বলছে, তা পারবে না, তবে হয়রান করতে পারে।
বিজু ছাদে বেরিয়ে এল। আকাশ গাঢ় মেঘলা। বৃষ্টি আসতেও পারে, বোঝা যাচ্ছে না।