মহীদা কান্তির কথা তুলে বলল, এ সবের মানে কী?
শুভঙ্কর বলল, কান্তিকে আপনি দোষী করতে চাইছেন?
হ্যাঁ, চাইছি। …মিষ্টির দোকানে বসে বাবা আর ছেলে খাবার খাচ্ছিল, কথা বলছিল, ছেলেটাকে দোকান থেকে বের করে এনে যারা তাকে খুন করেছে তার মধ্যে কান্তি ছিল।
অজয় বলল, যদি থেকেও থাকে তাতে আপনার কী? আপনি জানেন–ওই ছেলেটা ইনফরমার?
খাকি পোশাক পরলেই ইনফরমার হয়? তুমি জানো ও রেলের অফিসে খালাসির কাজ করত?
ওকে আপনি চেনেন, না বুর্জোয়া কাগজের খবরে পুলিশের তরফ থেকে যে গল্প বেরিয়েছে সেই গল্প বলছেন?
গল্প তোমরা বলছ! তোমাদের নরেনবাবুর ছেলেরা গল্প শোনাচ্ছে। …শোনো, আমি স্পষ্টই বুঝতে পেরেছি তোমরা সকলেই বোধ হয় উনিশবিশ নরেনবাবুর কথামতন বিপ্লব করতে চাও। তোমরা মনে করছ, কোনও রকম ছুতো তৈরি করে মানুষ খুন করার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে টেরার তৈরি করবে। তোমাদের এই বিপ্লব আর মানুষ খুনের সঙ্গে আমার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক আমি রাখতে চাই না। যা খুশি তোমরা করো, আমার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক তোমাদের নেই।
নীলেন্দু বুঝতে পারেনি, অজয় আর পল্লব আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল–মহীদাকে তারা আজ অপদস্থ করবে। বোধহয় নরেনবাবুদের কেউ সেই রকম পরামর্শ দিয়েছিল। ফলে অজয় আর পল্লব মহীদাকে অবজ্ঞা করতে লাগল। কোনও রকম সৌজন্য থাকল না, সঙ্কোচ রাখল না।
বিশ্রী রকম ঝগড়ার মধ্যে অজয় বলল, আপনার যদি মরার ভয় থাকে আপনি বাড়ি ফিরে যান, খাওয়াপরার অভাব তো নেই, আপনাকে আগলে রাখার মানুষও রয়েছে, আমাদের কিছু নেই, আমরা কারও পরোয়া করি না। যা দেখছেন, এই হবে, আরও হবে–আপনার মতন লোকের পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব হবে না। …।
মহীদা হঠাৎ জ্ঞান হারাল, প্রায় লাফ মেরে গিয়ে হাত ধরল অজয়ের, বলল, তুমি সাহস দেখাতে চাও, বিপ্লবী হতে চাও, চলো বড় রাস্তার মোড়ে একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। দুটো সার্জেন্ট গোছের পুলিশকে দেখেছি চায়ের দোকানের সামনে, হয়তো চা-ফা..চলো, খুন করে আসবে চলল। তারাও তো তোমাদের শোষণ আর নিপীড়ন যন্ত্রের প্রতীক।
অজয় ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল, খেপে গিয়ে বলল, হাত ছাড়ুন; ছেলেমানুষি করবেন না।
ছেলেমানুষির কী হল?
পুলিশ খুন যদি আমাকে করতেই হয়–আমি করব, তবে নিশ্চয় বোকার মতন নয়।
তার মানে তুমি বুদ্ধিমানের মতন খুন করবে, অর্থাৎ যখন রাস্তাঘাটে বেমক্কা কাউকে পেয়ে যাবে যে তোমাদের কলেকটিভ আক্রমণটা বুঝবে না। একে তোমরা সাহস বলল, বিপ্লবীর দুর্জয় কীর্তি বলো! …কিন্তু যে বা যারা দল বেঁধে লুকিয়ে একটা লোক মারে, তার সাহসটা কোথায়? লুকোনোর মধ্যে? না সুযোগ খোঁজার মধ্যে? যারা সুযোগ খুঁজে বেড়ায়, যারা লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ সেরে ফেলতে চায়–তারা ভবিষ্যতে কোন মেরুদণ্ড নিয়ে সামনাসামনি আসবে আমায় বলতে পারো?
পল্লব ব্যঙ্গ করে বলল, আপনি নিজের মেরুদণ্ড দেখুন, আমাদের মেরুদণ্ড দেখবার দরকার নেই।
অজয়ের হাত ছেড়ে দিয়েছিল মহীদা। পল্লবদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের যে মেরুদণ্ড আমি দেখলাম তাতে আমার ঘেন্না ধরে গেছে। বলতে লজ্জা করে, তোমাদের মেরুদণ্ডটাও যদি নিজের হত…। যাক গে, তোমরা খুনখারাপি করে বেড়াও গে যাও, তোমাদের বিপ্লব তোমাদের হোক, আমি আর কারুর সঙ্গেই কোনও যোগাযোগ রাখতে চাই না। …আমায় ভয় দেখাবার চেষ্টা কোরো না। তাতে সুবিধে হবে না। তা ছাড়া আমি বুঝতে পেরেছি, তোমাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বই বলল আর যাই বলল তার কোনও অর্থ নেই। তোমরা অন্য ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছ।
মহীদা সেদিনই এই মেলামেশা যোগাযোগ বরাবরের মতন বন্ধ করে দিল।
নীলেন্দু প্রথম দিকে খানিকটা নিশ্চল হয়ে পড়েছিল। বাস্তবিক পক্ষে শুভঙ্কর, গগন এরা কেউই খুন-টুনের দিকে যায়নি। হয়তো অজয় কিংবা পল্লবও যেত না। নরেনবাবুর দিকে যারা চলে গিয়েছিল বা যাচ্ছিল তাদের বাদ দিয়েও কিছু ছেলে তো ছিলমহীদা কেন তাদের কথা ভাবল না?
বোধ হয় ভাবা সম্ভব ছিল না। মহীদা বিশ্বাস করতে পারেনি, মানুষ খুন করা, স্কুল পোড়ানো, কলেজের লাইব্রেরি বা ল্যাবরেটরি তছনছ করা, যত্রতত্র কালাপাহাড়ি কাণ্ড করে বেড়ানো সকলে মেনে নেয়নি। গগনদের পাড়ায় যেদিন নামকরা একটা মেয়ে স্কুলের বাস পুড়িয়ে দিল কয়েকটা ছেলে মিলে আর কচি মেয়েগুলো ভয়ে অলিগলির মধ্যে ছোটাছুটি করতে লাগল সেদিন গগন পাড়ার সেই ছেলেগুলোকে বলেছিল: এরকম ঘটনা আর যদি আমাদের পাড়ায় ঘটে আমি তোমাদের দেখে নেব।
আসলে, যা কিছু ঘটেছিল এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাচ্ছিল, নানা দিক থেকে গোপনে এত রকমের বেনো জল ঢুকছিল, গুজব আর নানা রটনা এমন করে ছড়িয়ে পড়ছিল যে সত্যিসত্যি কী ঘটছে তা জানা যেত না। স্বার্থপরতা, বিদ্বেষ, ক্ষমতার লোভ-সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। নীলেন্দু নিজেই অবাক হয়ে ভাবত, এই কি তাদের কাম্য ছিল? তবে?
মহীদা আর দেবীদি তার আগেই কলকাতা ছেড়ে চলে গেছে। নানা ধরনের গুজব রটেছিল প্রথমে। কেউ কেউ বলত, দেবীদি মহীদাকে নিয়ে দিল্লি পালিয়ে গিয়েছে, কেউ বা বলত–মহীদা পুলিশের কাছে ইনফরমেশান সাপ্লাই করে পালিয়ে গিয়েছে, কারও কারও ধারণা হয়েছিল–মহীদা তার চরিত্র অনুযায়ী কাজ করেছে, মধ্যবিত্ত চরিত্র যা হয়, বিশ্বাসঘাতক।