এক একজন মানুষ থাকে যাদের প্রথম থেকেই ভাল লেগে যায়। মহীদা ছিল সেই রকম মানুষ। তার কথাবার্তা, ব্যবহারের মধ্যে কেমন এক আকর্ষণ ছিল যা টেনে নেয়। নীলেন্দু মহীদার খুব বড় একজন ভক্ত হয়ে উঠল।
হঠাৎ খবর শোনা গেল মুকুল জলপাইগুড়ির দিকে চা বাগানে ছিল–খুন হয়ে গিয়েছে। খবরটা নীলেন্দুর বড় লেগেছিল।
এরপর সব কেমন ওলটপালট হয়ে যেতে লাগল। এই বাংলাদেশে না ঘটল এমন কিছু নেই, নাগরদোলার দোলনার মতন এ একবার মাথায় চড়ে তারপর হু হু করে নেমে আসে, অন্যজন মাথায় চড়ে। সমস্ত কিছু বিশৃঙ্খল, চারদিকে অরাজকতা, খুনের পর খুন।
মহীদা বলত, এটা কোনও রাজনীতি নয়, স্বার্থনীতি; ক্ষমতায় বসে থাকার জন্যে স্বৈরাচার। কংগ্রেস একচ্ছত্র অধীশ্বর হয়ে বছরের পর বছর যেভাবে গোঁজামিল দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিল–এরাও সেই গোঁজামিলের শরিক।
তুই ভাল করে ভেবে দেখ নীলু, মহীদা বলত, পশ্চিমবাংলার হাল কোথায় এসে দাঁড়াল। আজ এখানে সবচেয়ে বেশি বেকার, শিক্ষিত অশিক্ষিত বলে কোনও কথা নেই, কর্মক্ষম যত মানুষ আছে এই স্টেটে তার শতকরা বিশ ভাগকেই আমি হয় পুরো বেকার না-হয় হাফ বেকার বলব। কেন? এই বিশ-বাইশ বছর ধরে তা হলে কী হল? জমিদারি উচ্ছেদ কাগজকলমে হল–কিন্তু জমিদার আর জোতদারদের লবি গভর্নমেন্টকে ঠুটো করে রাখল, আজও গ্রামের মানুষের সেই একই অবস্থা। ইন্ডাস্ট্রি বাড়াবারই বা কতটুকু হয়েছে। এক সময়ে এই পশ্চিমবাংলায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ ছিল সবচেয়ে বেশি, এখন নামতে নামতে তলিয়ে যাবার অবস্থা। কেন? আমাদের যারা কর্তা হয়ে বসে আছে মাথার ওপর তারা ওয়ার্থলেস, তাদের কিছু করার গরজ নেই, ক্ষমতা নেই, দূরদৃষ্টি নেই, কোনও রকমে মিনিস্ট্রি হাতে করে বসে থাকার ধ্যান ছাড়া কিছু করেনি। তারপর যারা এল, তারা আরও ওয়ার্থলেস, মানুষের জন্যে কিছু করবে বলে আসেনি, কোনও বড় আদর্শ নিয়েও আসেনি, এসেছিল কোনও ফিকিরে ক্ষমতা দখল করে নিতে। তার ফলাফল কী হয়েছে–তা তো দেখতেই পেলি, মারপিট খুনোখুনি, একে অন্যের গায়ে থুতু ছিটোনো, গুণ্ডা বদমাশদের পেট্রনাইজ করা…তাতেই দিন ফুরিয়ে গেল। এভাবে কিছু হয় না, হতে পারে না।
নীলেন্দু চোখ বন্ধ করে ছিল না, সবই দেখতে পাচ্ছিল–ঠিক যেভাবে ধীরে ধীরে ভেতরের চাপা ব্যাধি শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হয়ে পড়ে, সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যায়–ঠিক সেইভাবে চরম হতাশা ক্ষোভ, ক্রোধ, অবজ্ঞা, অবিশ্বাস সমাজের সর্বদিকে ছড়িয়ে গেল। নীলেন্দু নিজেই কখন তার মধ্যে জড়িয়ে পড়ল। মহীদাও সেই একই ব্যর্থতার শিকার।
একদিন মহীদা বলেছিল, দেবীদির সামনেই, দেখ নীলু, আমি জন্মকাল থেকেই আবর্জনার মধ্যে বেড়ে উঠেছি। আমার বাবা নমস্য চরিত্রের মানুষ ছিল না। মাকে ভাল লাগার মতনও কিছু আমার ছিল না। নতুন মা, কিংবা ধর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছোটমাও ভাল ছিল না। আমি অনাদর, অবহেলার মধ্যে বড় হয়ে উঠেছি। এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়, ঘৃণা ও রাগের বেশি কিছু থাকে না, এই সমাজের মানুষের মনে ঠিক সেই রকম অথরিটির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছাড়া কিছু নেই। রাগ, ঘৃণা, অবজ্ঞার বেশি তুই কিছু পাবি না। আমি হয়তো ব্যক্তিগত ব্যাপারটা কোনও রকমে সামলে নেবার চেষ্টা করি, কিন্তু সকলের কাছে সেটা আশা করা যায় না।
নীলেন্দু স্পষ্টই বুঝতে পারছিল, মানুষের সহ্যশক্তি শেষ হয়ে এসেছে। তারা রাম বা শ্যাম কারও কর্তৃত্বই আর মানতে রাজি না। যদি কোনও দলের মধ্যে নাম লিখিয়ে থাকো তবে ঠাকুরদেবতায় বিশ্বাসের মতন সেই দলের নেতাদের পায়ে পুস্পাঞ্জলি দিতে পারো, মিছিল করতে পারো, ইউনিয়ন করতে পারো, ঘেরাও করতে পারো–আর কিছু করতে পারো না। এও এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি, অনেক ক্ষেত্রে বর্বরতা।
তা হলে?
মহীদার কাছে যারা আসত তারা এর কোনও জবাব পেত না। কেননা মহীদার কোনও জবাব জানা ছিল না। যখন মন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, জ্বালা ধরে থাকে সর্বাঙ্গে, তখন শুধু কথা দিয়ে কাউকে শান্ত রাখা যায় না। নিষ্ক্রিয়তা কোনও কিছু দেয় না। মহীদা নিষ্ক্রিয় ছিল, বা থাকতে চেয়েছিল বলেই অনেকে নরেনবাবুর দলে যায়ায়াত করতে লাগল, কিংবা বলা যায় তারা সেখানে সক্রিয় হবার সম্ভাবনা দেখতে পেল।
তারপর দেখতে দেখতে যেন আগুন ধরে গেল।
মহীদা প্রথমটায় কী ভেবেছিল কে জানে কিন্তু অখুশি হয়েছিল। বলেছিল, এটা কী হচ্ছে? পোস্টার দিয়ে বিপ্লব হয়, মানুষ খুন করে বিপ্লব? আমি এসব বুঝি না। আমার দেশ আমারই–তার জন্যে বাইরে থেকে মহাপুরুষ ধার করে এনে তাকে দেবতা করতে হবে?
কিন্তু মহীদার সাধ্য ছিল না, বানের জল আটকে রাখার। দেখতে দেখতে মহীদা প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে গেল, কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ছাড়া আর কেউ আসত না তার কাছে। নরেনবাবুর ছেলেরা মহীদাকে গালাগাল দিত, ঘৃণা করত, বলত শালা দালাল, নপুংসক।
এই সময় একদিন মহীদার জানাশোনা একজন কান্তি, নরেনবাবুদের দলের সঙ্গে যার যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ, মির্জাপুর স্ট্রিটের কাছে এক খুনের মধ্যে ছিল। খবরটার মহীদার কানে পৌঁছতেই মানুষটা একেবারে খেপে গেল।
পরের দিন মহীদা শুভঙ্করদের সঙ্গে দেখা করল। সেখানে শুভঙ্কর অজয়, পল্লব, সিধু, গগনরা ছিল। নীলেন্দুও। কান্তি ছিল না।