দেবযানী মুখ নিচু করে চা খাচ্ছিল। মুখ গম্ভীর। অন্যমনস্ক।
মহীতোষ বলল, তুই ভুল করেছিস। আমার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করলে এখানকার কথা তুই জানতে পারতিস। পরিতোষ তোকে অন্তত বলত।
দেবীদির বাড়িতে বলেনি, বলে নীলেন্দু দেবযানীর দিকে তাকাল।
মহীতোষ বলল, দেবীর বাড়ির লোক জানে না। জানলেও বলত না! কেন বলত না তুই জানিস। তা ছাড়া তারা বোধ হয় জানতেও চায় না।
দেবযানী বলল, তারা কিছু জানে না।
নীলেন্দু বলল, তোমার নাম ও বাড়িতে অচল এটা তুমি জান? তুমি বেঁচে আছ না মরে গেছ এটাও ওরা জানতে চায় না।
দেবযানী উদাসীন ভাবে বলল, জানি। আমি ওদের কেউ নয়।
নীলেন্দু আচমকা বলল, তুমি কত টাকার গয়না নিয়ে পালিয়ে এসেছ দেবীদি? শুনেছি মোটা টাকার। আজকালকার বাজারে পনেরো বিশ হাজার হতে পারে। পাথর-টাথরও ছিল।
দেবযানী প্রথমটায় কথা বলল না, নীলেন্দুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর আস্তে করে বলল, আমি যা এনেছি সব আমার। আমার মা দিদিমা আমার জন্যে যা রেখেছিল। বাড়ির কারও কোনও জিনিস আমি নিইনি। বরং আমারই খুচরো কিছু আমি ফেলে এসেছি।
মহীতোষ দেবযানীকে দেখছিল। অসন্তুষ্ট হয়েছে দেবযানী। চোখের তলায় রাগের ভাব। কপাল সামান্য কুঁচকে উঠেছে।
মহীতোষ নীলেন্দুকে বলল, নীলু, তুই দেবীকে রাগিয়ে দিচ্ছিস।
নীলেন্দু দেবযানীকে দেখতে দেখতে হাসল, বলল, আমার ওপর রাগ করার কোনও কারণ নেই, মহীদা। আমি যা শুনেছি তাই বললাম। দেবীদি আমায় দেখে রাগ করছে না। করছ নাকি দেবীদি? নীলেন্দু ঠাট্টা করে বলল।
কথার জবাব দিল না দেবযানী।
নীলেন্দু বলল, আমায় দেখে দেবীদির যা হয়েছে আমি বুঝতে পারছি। ভয় পেয়েছে। বলে একটু থামল, আবার বলল, একটা কথা আমি সত্যি করেই বলছি মহীদা, দেবীদি যা ভাবছে তা নয়। আমায় কেউ তোমাদের কাছে পাঠায়নি। আমি নিজেই এসেছি। কেউ জানে না, আমি তোমাদের কাছে আসব। কাউকে আমি বলিনি।
দেবযানী স্থির চোখে নীলেন্দুকে দেখছিল।
চুপচাপ। মহীতোষ গায়ের চাদরের আলগা অংশটা মাটি থেকে গুটিয়ে নিতে নিতে বলল, বাইরে গিয়ে বসি চল নীলু, বাইরের বারান্দায় রোদ এসে গেছে।
.
০২.
বারান্দার গায়ে গায়ে পেয়ারাগাছ, গাছতলাতেই বসল মহীতোষ ছোট ছোট মোড়া বয়ে এনে। পুরোপুরি রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ বসা যাবে না ভেবেই মাথা বাঁচিয়ে গাছতলায় বসা।
নীলেন্দু প্রথমটায় কোনও কথা বলল না, আলস্যের ভঙ্গিতে বসে চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আকাশ পরিষ্কার, ফিকে নীল, সাদা রেখার মতন মেঘের দাগ রয়েছে কোথাও কোথাও; অফুরন্ত বোদ। রোদ যে অনেক গাঢ় ও তপ্ত হয়ে গেছে বোঝা যায়। মাটি ঘাস শুকিয়ে এসেছে, ভেজা ভেজা ভাবটা আর তেমন চোখে পড়ছিল না।
মহীতোষই কথা বলল। জায়গাটা কেমন লাগছে রে?
নীলেন্দু মহীতোষের দিকে তাকাল। হাসি মাখানো নিশ্চিন্ত মুখ। নীলেন্দু আশা করছিল, তাকে দেখে মহীদার মুখ গম্ভীর হয়ে যাবে, দেবীদির যেমন হয়েছে; মহীদা বিরক্ত হবে, উদ্বেগ বোধ করবে। আশ্চর্য, এখন পর্যন্ত তেমন কিছু হল না। মহীদা যদি উদ্বেগ বোধ করেও থাকে তার কোনও চিহ্ন মুখে ফুটে ওঠেনি। শুধু কৌতূহলের কিছুটা আভাস রয়েছে চোখে।
নীলেন্দু বলল, জায়গাটা ভালই বেছে নিয়েছ। কী করে বাছলে? এদিকে আগে এসেছ কখনও?
মহীতোষ বলল, একবার এসেছিলাম। বছর চারেক আগে।
তখন থেকেই কি তোমার মাথায় এই আখড়া খোলার প্ল্যান ছিল?
হাসল মহীতোষ। মাথা নাড়ল। নারে, তখন কিছুই ছিল না।
এই বাড়িটার মালিক কে?
দেবী।
নীলেন্দু অবাক হয়ে মহীতোষকে দেখতে লাগল। এক-আধবার এই ধরনের একটা সন্দেহ তার হয়েছে, তবে সে-সন্দেহ এমনই যে নীলেন্দু তা নিয়ে মোটেই ভাবেনি। তার মনে হয়েছিল, বাড়িটা মহীদারা ভাড়া নিয়েছে।
মহীতোষ নিজেই বলল, দেবী বাড়িটা কিনেছে। বেশিদিন নয়, মাস-দুই হল। এখানে জমি জায়গা সস্তা, বাড়িটাও ফাঁকা পড়েছিল, খুবই অল্প পয়সায় কিনে নিয়েছে।
নীলেন্দু অন্যমনস্ক ভাবে জিজ্ঞেস করল, বাড়িটা কার?
বাড়িটা ছিল এদিককারই এক অবাঙালি ভদ্রলোকের। কাঠের ব্যবসা করতেন। এদিকে ওদিকে আরও দু একটা বাড়ি তাঁর আছে। ভদ্রলোকের স্ত্রীর বাড়াবাড়ি ধরনের টিবি হয়; হাসপাতালে অনেকদিন ছিলেন। সেরে ওঠার পর স্ত্রীকে শুকনো ভাল জায়গায় রাখার জন্যে বাড়িটা করেন। বছর-দুই পরে মহিলা অন্য রোগে মারা যান, হার্টের রোগে। তারপর থেকে বাড়িটা ফাঁকা পড়ে ছিল। ওই যে আশিস, ওরই এক বন্ধু ভদ্রলোকের ভাগ্নে। ঝাড়গ্রামে ভদ্রলোকের অন্য সব ব্যবসা আছে। আশিসই খবরাখবর করেছিল। এই বাড়িটা রাখার ব্যাপারে ভদ্রলোকের কোনও গরজ ছিল না। হাজার আষ্টেক টাকায় বেচে দিলেন।
নীলেন্দু মন দিয়ে শুনছিল। মহীদারা কি তাহলে কলকাতা থেকে চলে আসার পর ঝাড়গ্রামে ছিল।
নীলেন্দু বলল, তোমরা কি আগে ঝাড়গ্রামে ছিলে?
ছিলাম কিছুদিন। তারপর এখানে চলে আসি। এই বাড়িতেই। ভাড়াটে ছিলাম।
নীলেন্দু গলার মাফলারটা খুলে ফেলল। শরীর তেতে উঠেছে রোদে। মাথাটা আরও একটু ছায়ার দিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আরাম করে বসল। বসে পায়ের জুতো মোজা খুলতে লাগল।
মহীতোষ গায়ের গরম চাদর কোলের কাছে গুটিয়ে নিয়ে বসেছিল। শান্ত ভাবেই। এখন বাতাস নেই। পেয়ারাগাছের পাতা যেন স্থির হয়ে আছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস বইতে শুরু করবে; আজ কদিন দুপুর থেকে শীতের হাওয়ার দমকা বাড়ছে, বিকেলের পর প্রবল হয়ে ওঠে। শীতও ক্রমশ বেড়ে চলেছে।