নীলেন্দু রোদে দাঁড়িয়ে থাকল। আরাম লাগছে। এখানে দাঁড়িয়ে কুয়াতলা দেখা যায়, কাছেই, পঁচিশ ত্রিশ গজ দূর হবে হয়তো। পেছনের দিকটায় ভাঙা পাঁচিল। কুয়াতলার ওপাশে নিমগাছ, বেশ শীর্ণ।
দেবযানী চা এনে টেবিলের ওপর রাখল।
মহীদা কই?
আসছে। এখুনি এসে পড়বে। তুমি চা খাও।
তুমি খাবে না?
খাব।
নীলেন্দু চেয়ারে বসল। তোমাদের এখানে প্রচণ্ড শীত।
আরও পড়বে শুনেছি।
কষ্ট হয় না তোমাদের? কলকাতার লোক।
আস্তে মাথা নাড়ল দেবযানী। না, সহ্য হয়ে যাচ্ছে। বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল আবার।
নীলেন্দু চা খেতে খেতে আবার একটা সিগারেট ধরাল। মহীদা তাকে দেখলে কতটা চমকে যাবে বলা যাচ্ছে না। বোধহয় বিশ্বাসই করতে পারবেনা, নীলেন্দু স্বেচ্ছায় এখানে এসেছে। অন্য রকম ভাবতে পারে মহীদা। ভাবাই স্বাভাবিক। ভেবে সন্ত্রস্ত হবে, নীলেন্দুকে মোটেই পছন্দ করবে না, বিশ্বাস করবে না।
নীলেন্দু মহীতোষের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। কোন দিক দিয়ে মহীতোষ আসবে বুঝতে না পেরে সে একবার ঘরের দিকে আর একবার ভেতর বারান্দার জাফরির দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। ভেতর বারান্দার সবটাই জাফরি আর জাল দিয়ে ঘেরা, বাইরে চৌকো জাল, কাঠের ফ্রেম আটকানো; ভেতর দিকে পাতলা গোেল জাল।
ঘরের ভেতর দিয়েই মহীতোষ এল। নীলেন্দুকে দেখে থমকে দাঁড়াল। দেখল দু পলক। এগিয়ে এল। নীলু! তুই?
নীলেন্দু মহীতোষকে দেখতে লাগল। প্রায় ছ সাত মাস পরে দেখা। মনে মনে নীলেন্দু অন্য রকম ভেবেছিল। ভেবেছিল, মহীদার মুখে ঘন দাড়ি, পরনে গেরুয়া, মাথায় লম্বা লম্বা বাবাজি মার্কা চুল দেখতে পাবে। সেসব কিছুই দেখা গেল না। মাথার চুল অবশ্য বড় বড়, কিন্তু তাকে বাবাজি মার্কা বলা যায় না।
কাছে এসে মহীতোষ নীলেন্দুর কাঁধের কাছটায় হাত রেখে চাপ দিল। তুই কী করে এলি? আমি ভেবেছিলাম অন্য কেউ!
কোন দিকে ছিলে তুমি? আমি তো দেখতে পাইনি।
মহীতোষ বাড়ির পেছন দিকটা দেখাল। বলল, তুই সামনে দিয়ে এসেছিস, আমি পেছনের দিকে মাঠে বেড়াচ্ছিলাম। খানিকটা দূরে একটা ছোট নদী আছে। হাঁটতে হাঁটতে নদী পর্যন্ত চলে যাই। ফেরার মুখে শুনলাম কোন এক বাবু এসেছে।
তাই বলো! তোমায় খবর পাঠিয়েছিল দেবীদি।
কেমন আছিস তুই?
কেমন দেখছ। তুমি কেমন আছ? …তোমরা? নীলেন্দু যেন একটু হাসল।
মহীতোষ চেয়ারে বসল। দেবযানী চা এনেছে। দু কাপ। মহীতোষের সামনে একটা কাপ নামিয়ে রেখে বলল, তোমরা বোসো, আশিসকে চা দিয়ে আসি।
নীলেন্দু চা খেতে খেতে মহীতোষকে লক্ষ করতে লাগল।
মহীতোষ চায়ের পেয়ালা টেনে নিয়ে চুমুক দিল। মুখ তুলে বলল, কী দেখছিস।
দেখছি তোমার কতটা পরিবর্তন হল?
মহীতোষ শান্ত চোখে হাসল। কিছু দেখতে পাচ্ছিস?
সিগারেটের ধোঁয়া গিলে ফেলল নীলেন্দু। তেমন আর কোথায়! গায়ের রং প্রায় আমার মতনই হয়ে এসেছে, চোখেমুখেও তো কোনও দিব্য জ্যোতি দেখছি না, বরং তোমার শরীর খানিকটা শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে। নীলেন্দু এমনভাবে বলল যেন সে যা বলছে তার সম্পর্কে নিজেও তেমন নিশ্চিত নয়। তার মুখে সামান্য হাসি-হাসি ভাব ছিল।
মহীতোষ হাসছিল। বলল, শীতে শরীর শুকোয় তুই জানিস না?
নীলেন্দু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, না ওসব জানি না। …কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি অবাক হচ্ছি, মহীদা; আমি ভেবেছিলাম তুমি এতদিনে দিব্যি দাড়িকাড়ি গজিয়ে ফেলবে, মাথার চুল হাতখানেক লম্বা হবে। সেসব কোথায়?
মহীতোষ সামান্য জোরে হেসে উঠল।
দেবযানী ফিরে এসে রান্নাঘরে গিয়েছিল, তার চা নিয়ে নীলেন্দুদের কাছে এসে বসল।
মহীতোষ বলল, দেবী, আমার এই মুখ নীলুর পছন্দ হচ্ছে না।
দেবযানী নীলেন্দুর দিকে তাকাল।
নীলেন্দু বলল, মিথ্যে বলব না দেবীদি, যেখানে যা মানায় তা না থাকলে চোখে লাগে। তোমাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, এখানকার কারবারটা তোমরা গুছিয়ে উঠতে পারোনি।
নীলেন্দুর গলার শ্লেষ দেবযানীর কানে লাগল। মহীতোষও হয়তো লেগেছিল। কিন্তু তার মুখ সহাস্যই থাকল। দেবযানী যেন ক্ষুণ্ণ হল। বলল, তুমি কি আমাদের কারবারের লাভক্ষতি দেখতে এসেছ?
মহীতোষ দেবযানীর মুখের দিকে তাকাল। মনে হল এই বিরক্তি তার পছন্দ হল না।
নীলেন্দু সিগারেটের শেষ ধোঁয়াটুকু গিলে ফেলে স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি তো জান দেবীদি, আমি জাত ব্যবসাদারের ছেলে, লাভের কারবার দেখলে আমার লোভ বেড়ে যায়, ইচ্ছে করে দু পয়সা খাঁটিয়ে নি। বলে নীলেন্দু হাসতে লাগল।
মহীতোষ প্রসঙ্গটা পালটে নেবার জন্যে বলল, তোদের দু জনের সেই সাপে-নেউলের সম্পর্কটা আর শোধরাল না। …ওসব কথা থাক, এবার আমায় বল তো নীলু, তুই কী করে জানলি আমরা এখানে আছি?
সিগারেটের টুকরোটা কাপের মধ্যে ফেলে দিল নীলেন্দু। সামান্য চুপ করে থেকে বলল, কানে এসেছিল।
কী করে কানে এল?
গিরিজা বলছিল। সে নাকি শুভঙ্করের কাছে শুনেছে। বাসুদেবের কাছেও শুনে থাকতে পারে। তুমি কি তোমার ভাইকে কোনও চিঠি লিখেছিলে?
লিখেছি এক-আধ বার।
তার মুখ থেকেও শুনতে পারে।
তুই কি আমার বাড়িতে খোঁজ করেছিলি?
না। …খোঁজ করলে লাভ হত বলে আমার মনে হয়নি। আমি উড়ো খবর শুনেই এসেছি। তোমাদের এখানে সত্যিসত্যি দেখতে পাব ভাবিনি। ভেবেছিলাম, নাও পেতে পারি। না পেলে ফিরে যেতাম।