নীলেন্দু এবার সামান্য জোরে হাসল। বলল, কিছু মনে কোরো না, আমি একটু জেলাস; তোমার ভাইয়ের সংখ্যা বাড়লে আমার বুক কাঁপে, বলে নীলে বাঁ হাতে তার বুক দেখাল। তারপর সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে একমুখ ধোঁয়া গিলে বলল, যাক গে, এসে পর্যন্ত তোমার সঙ্গে ঝগড়া করছি। …মহীদা কোথায়?
কাছাকাছি কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রাতঃভ্রমণ! …তা তোমরা কেমন আছ?
ভালই।
নীলেন্দু সামনের দিকে তাকাল। রোদ ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। সামান্য ঝকঝক করছিল। মহীদা আশেপাশে কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে, হয়তো এখুনি এসে পড়বে। কেমন যেন প্রত্যাশার চোখ নিয়ে নীলেন্দু ফটকটার দিকে তাকিয়ে থাকল।
দেবযানী বলল, তোমরা কেমন আছ?
নীলেন্দু সেকথার কোনও জবাব না দিয়ে বলল, তুমি যে আজকাল অতিথিকে এই ভাবে অভ্যর্থনা করো জানতাম না, দেবীদি! দু পায়ে একটানা দাঁড় করিয়ে রেখেছ?
দেবযানী সামান্য অপ্রতিভ হল, বলল, না, না, আমি ঠিক খেয়াল করিনি। এমন আচমকা এলে যে অবাক হয়ে গিয়েছি। এসো, ভেতরে এসো৷ বলে দেবযানী নীলেন্দুর ব্যাগ নিজেই উঠিয়ে নিতে যাচ্ছিল। নীলেন্দু বাধা দিল, দিয়ে ব্যাগটা উঠিয়ে নিল।
ভেতরে এসে দেবযানী নীলেন্দুকে যে ঘরে বসতে বলল, সেই ঘরে আশিসের বিছানা,–চারটে জামাকাপড় ছড়ানো। আশিস হাতমুখ ধুয়ে আসতে কুয়াতলায় গিয়েছে।
শীতের রোদ এখনও এ-ঘরে ঢোকেনি, জানলার বাইরে পড়ে আছে। বড় বড় একটা জানলা। খড়খড়ি দেওয়া। সবুজ রং। জানলার কাঠ মাঝে মাঝে ফেটে যাচ্ছে। দরজা একটাই। বেশ উঁচু। ঘরের মাথায় চটের সিলিং, চুনকাম করা। ঘরের একপাশে একটা বিছানা, তক্তপোশের পায়াগুলো দেখা যাচ্ছিল। কাঠের সাধারণ চেয়ার একপাশে। দেওয়াল-আলনায় আশিসের জামা ঝুলছে।
নীলেন্দু ঘরের চারপাশ দেখতে দেখতে বলল, কটা ঘর?
তিনটে।
এটা বোধ হয় তোমাদের অতিথিশালা?
দেবযানী বিছানাটা পরিষ্কার করতে লাগল। চাদরটা উঠিয়ে নিল, কাঁচতে দেবে। বাড়তি চাদর আছে দেবযানীর ঘরে। কম্বলটা পাট না করে আপাতত বিছানার ওপর ছড়িয়ে দিল। আশিসের খুচরো জিনিসগুলো একপাশে জড়ো করে রাখল।
তুমি একটু বোসো; চায়ের জল বসিয়ে আসি।
নীলেন্দু গলার মাফলার খুলে রেখে বিছানার ওপর বসল।
দেবযানী চলে গেল।
সামান্য বসে থেকে নীলেন্দু বিছানার ওপর আড় হয়ে শুয়ে পড়ল। পায়ে জুতো মোজা, পা দুটো ঝুলিয়ে রাখল। কাল গাড়িতে ঘুম প্রায় হয়নি। ভিড় খুব। শীতও মন্দ ছিল না। মনের মধ্যে উদ্বেগও ছিল। উদ্বেগ আর চিন্তা। মহীতোষদাকে সত্যিই পাওয়া যাবে কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ ছিল। খবরটা তার কাছে কেমন উড়ো উড়ো লেগেছিল। গিরিজা কার কাছে কোথা থেকে মহীতোষদের খবর পেয়েছে স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। একবার শুভঙ্করদার কথা বলল, একবার বলল মহীতোষদার ভাইয়ের মুখে শুনেছে। আবার বলল, মহীতোষদার একটা চিঠি সে দেখেছে বাসুদেবের কাছে। এলোমেলো উলটোপালটা খবর শুনে কাউকে খুঁজতে আসা নিশ্চয় বোকামি। নীলেন্দু অনেক ভেবেচিন্তে সেই বোকামিটুকু করার ঝুঁকি নিল। অবশ্য তার মন বলছিল: এই রকম হতে পারে। মহীতোষদাকে পাওয়া যেতে পারে। দেবযানীদিকেও।
বিছানার ওপর গা ভেঙে শুয়ে থাকতে থাকতে নীলেন্দু এপাশ ওপাশ করল, হাই তুলল।
এমন সময় আশিস ঘরে এল। এসে বিছানায় নীলেন্দুকে শুয়ে থাকতে দেখে কেমন সঙ্কুচিত হয়ে উঠল।
বিছানায় উঠে বসল নীলেন্দু। বসে আশিসের দিকে হাসি-হাসি মুখ করে তাকাল। বলল, আমার নাম নীলেন্দু। কলকাতা থেকে এসেছি। মহীদাদের অনেকদিনের চেনাজানা, বন্ধুর মতন। আপনি দেবীদির ভাই শুনলাম।
আশিস প্রথমটায় যেন কী বলবে বুঝতে পারল না; পরে বলল, ওঁকে আমি দিদি বলি।
কোনও রকম আত্মীয়?
না।
দেবীদিকে আমি অন্তত আট-দশ বছর ধরে চিনি। বাড়ির সকলকেই। আপনাকে কখনও দেখিনি তাই বললাম। …আপনি কি আজই ফিরে যাচ্ছেন?
আশিস মাথা নাড়ল। হ্যাঁ।
কোথায় থাকেন ভাই আপনি?
ঝাড়গ্রাম।
ঝাড়গ্রাম! তা হলে তো কাছেই।
আশিস মাথা নাড়ল।
নীলেন্দু আরও ভালভাবে লক্ষ করছিল আশিসকে। কলকাতার চেহারা যে নয় বুঝতে তেমন কষ্ট হয় না। মফস্বল শহরের ছাপ রয়েছে চোখে মুখে, খানিকটা কুণ্ঠিত আড়ষ্ট, সামান্য যেন গ্রাম্যতা রয়েছে। চেহারায়। আশিসকে কেমন লাজুক, সরল, শান্ত-টান্তই দেখায়। নীলেন্দুর মনে হল, ছেলেটির বয়েস তার চেয়েও অনেকটা কম, অন্তত পাঁচ-সাত বছরের। চালাক চতুর বা বিশেষ বুদ্ধিমান বলেও মনে হয় না। মহীদা আর দেবীদি এই ছেলেটাকে ভিড়িয়ে ফেলেছে নাকি?
আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল নীলেন্দু দেবযানী ঘরে এসে পড়ল। বলল, চল, চা খাবে চল। তোমার মহীদাও আসছে।
নীলেন্দু উঠে দাঁড়াল।
দেবযানী আশিসকে বলল, তুই দুটো ভাত খেয়ে যাবি না?
না, আশিস মাথা নাড়ল।
খেয়ে গেলে পারতিস। কোর্ট হয়ে বাড়ি ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে।
বিকেল হবে না, আশিস বলল, আগে আগে চলে যাব।
যাবার আগে জলখাবার খেয়ে যাবি! চা খাবি আয়।
যাচ্ছি।
দেবাযানী চোখের ইশারায় নীলেন্দুকে ডেকে নিয়ে চলে গেল।
বাড়ির পেছন দিকে ঢাকা বারান্দায় এনে দেবযানী নীলেন্দুকে বসতে বলল।
বারান্দার পুব দিক ঘেঁষে রোদ পড়েছে। সাধারণ একটা টেবিল একপাশে, দু তিনটে মামুলি চেয়ার। বারান্দার অন্যদিকে বুঝি রান্নাঘর। ছোট। গায়ে গায়ে আরও একটা চিলতে মতন ঘর, ভাঁড়ার হতে পারে।