দেবযানী কথা বলল না। আজ কিছুদিন ধরে বাড়াবাড়ি ধরনের ঠাণ্ডা পড়ে যাওয়ায় রাত্রের দিকটায় মাটির মালসায় কাঠকয়লার আগুন এনে ঘরে রাখতে হচ্ছে প্রায়ই। দেবাযানী এসব জানত না; তার জানার কথাও নয়; লাটু শিখিয়ে দিয়েছে, জামকাঠের ডালপালা পুড়িয়ে কাঠকয়লাও করে দিয়েছে এক ঝুড়ি।
মহীতোষ বলল, নীলু কোথায়?
ঘরে।
তোমরা স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলে, না আর কোথাও বেড়ালে?
স্টেশন থেকে ফিরে এসেছি।
ভালই করেছ, মহীতোষ আবার টেবিলের ওপর মাথা নোয়ালোলা। এখানে ঠাণ্ডায় বেশি ঘোরাঘুরি নীলুর সহ্য হবে না; ও তো আবার প্লুরিসিতে ভুগেছে।
দেবযানী চুপ করে থাকল। নীলেন্দুর প্লুরিসিতে ভোগার ইতিহাস ওর অজানা নয়। বছর দুয়েক আগে বর্ষার শেষ দিকে, পুজোর পর পর নীলেন্দু অসুখটা বাধিয়ে তুলেছিল, ভুগেছিল বেশ কিছুদিন, শরীর ভেঙে গিয়েছিল, মাস দুই ঘরের বিছানায় পড়েছিল। সেই ভাঙা শরীর সারাতে কম সময় যায়নি। এখন নীলেন্দুকে দেখলে তার অসুখের কথা মনে পড়ে না। দেবযানীরও মনে হয়নি। মহীতোষের কথায় মনে পড়ল।
ওকে বরং আগুন দিয়ে এসো, মহীতোষ বলল, সাবধানে থাকতে বলল, বাহাদুরি করলে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। …কী করছে নীলু?
ঘরে।
কিছু দিয়েছ ওকে? গরম কিছু দাও খেতে।
দেবযানী বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি আমায় মেয়েলি ব্যাপার শিখিও না। তোমার নীলুকে যা দেবার আমি দেব। তোমার নিজের আগুন লাগবে কিনা বলো? চা খাবে, না খাবে না?
আগুন লাগবে না। নীলুর জন্যে চা করলে একটু দিতে পারো।
দেবযানী আর কিছু বলল না। সামান্যক্ষণ বসে থাকল। বসে বসে মহীতোষকে দেখতে লাগল। মহীতোষ কোনওকালেই তেমন সুপুরুষ ছিল না যে চোখ তুলে দেখলে আর পলক পড়বে না। তার গায়ের রং উজ্জ্বল হলেও তেমন কিছু গৌরকান্তি নয়, মাঝারি রকমের ফরসা বড় জোর। মাথায় সাধারণত লম্বা, পুরুষমানুষের পক্ষে যতটা না হলেই নয়, দেবযানীর চেয়ে কয়েক আঙুল মাত্র দীর্ঘ মাথায়। প্রচণ্ড স্বাস্থ্য নয় মহীতোষের, বরং ছিপছিপে গড়ন। মুখ খানিকটা তেকোনা ধরনের–অর্থাৎ গালের চোয়াল পাতলা, থুতনি সরু; মোটামুটি লম্বাটে কপালের তলায় গাল এবং থুতনির এই গড়ন খানিকটা তেকোনা দেখাবারই কথা। মহীতোষের ঘন, জোড়া ভুরুর তলায় মোলায়েম শান্ত চোখ তার স্বভাবের নরম দিকটা যেন প্রকাশ করে ফেলে। এই চোখ নরম, শান্ত, কিন্তু কেমন যেন দ্বিধাপূর্ণ। কখনও কখনও উদাসীন মনে হয়। আবার এই চোখে দেবাযানী একসময়ে যে উত্তেজনা ও আবেগ দেখেছে তাও যেন ভুলে যাবার কথা নয়। মহীতোষের শক্ত সরু নাক, তার ঝকঝকে দাঁত, পাতলা বাঁকানো ঠেটি–মানুষটার কোনও শক্তি এবং জেদের আভাসও যেন দেয়।
টুল থেকে উঠে পড়ল দেবযানী। হাতে কাজ রয়েছে।
নিজের ঘরে এসে দেবযানী লণ্ঠনের আলো বাড়িয়ে নিল। তার ঘরের সঙ্গে মহীতোষের ঘরের তেমন কোনও প্রভেদ নেই। আকারের দিক থেকে সামান্য ইতরবিশেষ হলেও সেই বড় বড় জানলা গোটা দুই, মাথার ওপর চটের সিলিং, দেওয়ালের কোথাও কোথাও পাতলা ছোপ ধরেছে। আসবাবপত্র হয়তো এ ঘরে সামান্য বেশি। খাটটা সামান্য সুদৃশ্য, ছোট মাপের একটা আলমারি আছে কাঠের, দেওয়ালের একদিকে বড় আয়না ঝোলানো, তার তলায় সরু ব্র্যাকেট; গদিমোড়া একটা ইজিচেয়ারও রয়েছে কোণ ঘেঁষে। আরও কিছু খুচরো, ছোটখাটো আসবাবপত্র। বাড়িটা কেনার সময় এই আসবাবপত্রও কিনে নিতে হয়েছিল। প্রয়োজন তো ছিলই। আর কিছু কিছু আশিস জোগাড় করে এনেছে।
গায়ের শাল খুলে রেখে দেবযানী শাড়িটা পালটে নিল। এক সময়ে তার নানা ধরনের শখের মধ্যে ছিল শাড়ির শখ। সিল্ক সে পছন্দ করত বরাবর, ভালবাসত, বিশেষ করে একরঙা বা হালকা করে ছাপা সিল্কের শাড়ি। তাঁতের মধ্যে ধনেখালি তার ভাল লাগত।
এখনও কলকাতার বাড়িতে দেবযানীর ঘরের আলমারি খুললে একরাশ আলমারি ভরতি শাড়ি পাওয়া যাবে। দু-এক বছরের জমানো নয়, আরও বেশিদিনের। কত রকম জায়গা থেকে কিনেছিল, কোনওটা কলেজ স্ট্রিট থেকে, কোনওটা মার্কেট থেকে, কোনওটা বা গড়িয়াহাট থেকে। সেসব আজও আছে! থাকা উচিত। অবশ্য দেবযানী জানেনা, তার ঘর আজও ফাঁকা পড়ে আছে কিনা কিংবা অন্য কারও দখলে চলে গেছে। দখল করলে ছোটবউদিই করতে পারে। ছোটবউদি বরাবরই, বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে পর্যন্ত তার ঘরের দিকে চোখ দিত। দিত–কেননা ছোড়দার বিয়ের পর তেতলার যেদিকটা তাকে ছেড়ে দেওয়া হল–সেদিকে পুব-দক্ষিণ বন্ধ; উত্তর দিকে একটা বার্লির কারখানা। পশ্চিম দিকে চোখ মেলে থাকা ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। আর পশ্চিমে সেই খাল, দু-চারটে গাছ, একটানা বস্তি ছাড়া কিছু নেই। দেবযানীর ঘরটা পেলে ছোটবউদি সকালের দিকে পুবের রোদ পাবে, বারান্দায় বসলে অন্তত বার্লি কালখানার দিকে না তাকিয়ে থাকা যাবে। তা ছাড়া, কোনও কোনও মানুষ, নতুন হলেও, কোথাও আসা মাত্র তার দাবিটা জানাতে লজ্জা পায় না। ছোটবউদি সেই রকম। শ্বশুরবাড়িতে এসেই জানিয়ে রেখেছে দেবযানীর বিয়ে হয়ে গেলে ঘরটা তারই প্রাপ্য।
শাড়ি বদলে দেবযানী বাড়িতে পরার ছোট, করকরে শালটা গায়ে জড়িয়ে নিল। শাড়িটা সাধারণ। সাদা খোলের। পাড়ও মামুলি। কলকাতার বাড়ি থেকে চলে আসার সময় দেবযানী কিছুই নেয়নি, তার সুটকেসে গয়না ছাড়া দু-চারখানা শাড়ি জামা ছিল যা নিতান্ত সব সময়ে প্রয়োজন হবে বলে সে নিয়েছিল। আজকাল যা পরেটরে তার কোনওটাই সেই শাড়ি-টাড়ি নয়। বাড়ি থেকে কিছু আনতে দেবযানীর ইচ্ছে হয়নি, সুযোগও ছিল না। গয়না আর নেহাত যা দরকারে লাগবে, দু-চারটে শাড়ি জামা ছাড়া বাবার একটা ছোট ফটো এনেছিল ফ্রেমে বাঁধানো। ছবিটা তার ঘরের দেওয়ালে সে ঝুলিয়ে রেখেছে।