দেবযানী ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখবার চেষ্টা করল নীলেন্দুকে। ভয় এবং বিমূঢ়তা তার দৃষ্টিকে যতটা আচ্ছন্ন করেছে প্রায় ততটাই অস্পষ্ট করেছে এই অন্ধকার নীলেন্দুর চোখ-মুখ। কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, নীলেন্দু হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে নাকি এই অবস্থায় দেবযানীর মুখ কতটা ভয়ার্ত, রক্তশূন্য হয়েছে দেখবার চেষ্টা করছে।
নিজের শিউরে ওঠার ভাবটা অনুভব করতে পারল দেবযানী। বুক কাঁপছে কি কাঁপছে না খেয়াল হল না। নীলেন্দুর নীচের ঠোঁট পুরু, ওপর এবংনীচের ঠোঁট খোলা রয়েছে, সামনের দাঁতের সাদা অংশ সামান্য যেন দেখা যাচ্ছিল। দেবযানীর মনে হল, এই ভয় এই আতঙ্ক তাকে সারাদিন অস্থির করে রেখেছিল, স্বস্তি দিচ্ছিল না যদিও তবু শেষ পর্যন্ত সে নীলেন্দুকে বিশ্বাস করতে চাইছিল। মহীতোষ তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেছিল: তুমি ভাবছ কেন, নীলু নিজের ইচ্ছেয় এসেছে, নিজের মরজিতে। কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করে নেবার মতন মনের অবস্থা দেবযানীর নয়, তবু সারাদিন নানারকম ভাবতে ভাবতে, নীলেন্দুকে লক্ষ করে তার ধারণা হচ্ছিল, হতেও পারে কোনও দ্বিতীয় উদ্দেশ্য নিয়ে নীলেন্দু আসেনি।
এখন দেবযানীর আর কোনও সন্দেহ রইল না, নীলেন্দু পাকাপাকি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে। তার প্রবল ভয় হচ্ছিল।
নীলেন্দু দেবযানীর আতঙ্ক অনুভব করতে করতে বলল, তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছ দেবীদি।
দেবযানী কিছু বলল না। আর সহসা অনুভব করল, তার বুক ধকধক করছে, দ্রুত ঘা পড়ছে হৃৎপিণ্ডে। কেমন এক ধরনের রাগ, আক্রোশ, ঘৃণা তাকে জ্ঞানহীন করে তুলেছে।
তুমি তোমার মহীদাকে মিথ্যে কথা বলেছ? রুক্ষ কর্কশ গলায় দেবাযানী বলল।
নীলেন্দু বেশ শান্ত ভাবে বলল, তা বলে থাকতে পারি। বলার পর নীলেন্দু নিজেরই মনে হল, এ একেবারে থিয়েটারের ব্যাপার হচ্ছে। বড় নাটকীয়। এবং ছেলেমানুষি। হঠাৎ সে হেসে উঠল। হাসিটা তেমন জোর নয়, কিন্তু সহজ।
দেবযানীর পিঠে হাত রাখল নীলেন্দু, দু-চারবার আলতো করে চাপ দিল। তারপর পিঠের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দেবযানীর হাত ধরে ফেলল আচমকা।
দেবযানীর হাত ঠাণ্ডা কনকন করছিল। নীলেন্দুরও হাত গরম নয়।
নীলেন্দু বলল, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম, দেবীদি। দেখছিলাম, আমার সম্পর্কে তোমার মনোভাবের কোনও অদলবদল হল কিনা। পুরো একটা বেলা তো কাটল। …যাকগে, তোমায় সত্যি কথাটা বলি। আমি তোমার মন দেখছিলাম। আমার কাছে ভয় পাবার মতন কিছু নেই। তুমি আমার সমস্ত কিছু তন্নতন্ন করে খুঁজলেও কিছু পাবে না।
দেবযানী কথা বলল না, বড় নাগরদোলার চূড়ায় উঠেনীচে নেমে আসার মতন তার উত্তেজনা ক্রমশ কমে আসছিল।
নীলেন্দু দেবযানীর দু হাত আরও চেপে ধরে বলল, দেবীদি, তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারছ না?
দেবযানী নীলের হাতের চাপ অনুভব করতে করতে বড় করে নিশ্বাস ফেলল।
.
০৪.
বাড়ি ফিরে দেবযানী দেখল, মহীতোষ নিজের ঘরে বসে কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছে। ঘরের জানলা বন্ধ। এত ঠাণ্ডার মধ্যে কোনও কিছু খুলে রাখার উপায় নেই। শীতের এই সময়টায় মশাও হয় বেশ। ঘরের বাতাসে মশামারা সেই ধূপের গন্ধও রয়েছে। কাঠের ছোট টেবিলের সামনে ঝুঁকে বসে কেরাসিনের টেবিল বাতির আলোয় মহীতোষ মন দিয়ে কাজ করছিল।
দেবযানী মহীতোষের পিঠের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। কিছু বলবে মহীতোষ, কোনও রকম সাড়া দেবে যেন এই অপেক্ষায় দেবযানী দাঁড়িয়ে থাকল।
কিছু বলছিল না মহীতোষ, হাতের কাজ শেষ করে নিচ্ছিল।
দেবযানী কী যেন বলতে গিয়েও বলল না। সামান্য সরে গিয়ে উঁচু টুলটার ওপর বসল। বসে অন্যমনস্কভাবে ঘরের চারিদিকে তাকাতে লাগল।
মহীতোষের এই ঘরে নতুন করে দেখার কিছু নেই, অন্তত দেবযানী লক্ষ করতে পারে এমন কিছুই নয়। সাধারণ ছোট তক্তপোশ একপাশে, বিছানা পাতা, মোটা একটা সুজনি দিয়ে ঢাকা; সস্তা আলনা, দেওয়াল তাকের ওপর দু-চারটে খুচরো জিনিস, ছোট আয়না চিরুনি, এক শিশি মলম, শুকনো হরীতকী কয়েকটা, দু-চারটে বই, কিছু পুরনো কাগজপত্র। একটা বাক্স একপাশে দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে রাখা।
দেবযানী হঠাৎ যেন কেমন বিরক্তি বোধ করল। কেন করল সে জানে না। হয়তো এই বাড়াবাড়ি ধরনের অনাড়ম্বর গৃহসজ্জাই তাকে বিরক্ত করল; বা মহীতোষ কোনও কথাবার্তা বলছে না বলেই সে বিরক্ত হচ্ছিল।
দেবযানী নিজেই কথা বলল। তোমার ঘরে আগুন লাগবে?
মহীতোষ মুখ না তুলেই বলল, কটা বাজল বলো তো?
সাড়ে সাতটাত হবে, দেবযানী মোটামুটি অনুমান করে বলল। বাড়ি ফেরার সময় কলকাতা থেকে আসা এক্সপ্রেস গাড়িটা চলে যেতে দেখেছে সে; ট্রেনের সময় হিসেব করে দেখলে এখন ওই রকম সোয়া সাত কি সাড়ে সাত হবে।
মহীতোষ বলল, নীলুকে দাও। এখানকার এই ঠাণ্ডা ওকে জমিয়ে ফেলবে।
দেবযানী অসন্তুষ্ট গলায় বলল, নীলুর জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না। বাইরে খুব ঠাণ্ডা। ঘরের ভেতরও কনকন করছে। আগুন লাগবে কিনা বলো?
মহীতোষ ঘাড় উঠিয়ে দেবযানীর দিকে তাকাল। টুলের ওপর কাছাকাছি দেবযানী বসে। তবু এই টেবিল বাতির মিটমিটে আলোর অত উজ্জ্বলতা নেই যে দেবযানীর মুখ স্পষ্ট করে দেখা যাবে। লক্ষ করতে করতে মহীতোষ বলল, এখন লাগবে না; পরে যদি দরকার হয় বলব।