মাঠ ছাড়িয়ে রাস্তায় উঠল নীলেন্দুরা; দুজনেই চুপচাপ। রাস্তার পাশে ঢালু মাঠ, কোথাও কোথাও গরিব গেরস্তির ছোট ছোট ক্ষেত, সবজি ফলানো হয়েছে। কিছুই এখন চোখে পড়ার উপায় নেই, কুয়াশার পুঞ্জ যেন অন্ধকারের সঙ্গে মেশান।
নীলেন্দুই শেষে কথা বলল। দেবীদি, তোমার সঙ্গে আমার কতকগুলো কথা আছে। যদি বলো এইবেলা সেরে নিতে পারি।
দেবযানী দু মুহূর্ত নীরব থাকল, তারপর লঘু গলায় বলল, তোমার কথা কি এত অল্পে সারা হবে?
হবার কথা নয়, নীলেন্দু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, তবু শুরু করা যাক; গোড়ার কথাটা হয়ে যাক।
বলো।
নীলেন্দু গলার করকরে মাফলারটা আরও ঘন করে জড়িয়ে নিল। বলল, তুমি কলকাতা থেকে পালিয়ে আসার আগে আমায় ঘুণাক্ষরেও কিছু জানালে না কেন? ভয়ে?
দেবযানী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। হাঁটতে লাগল। রাস্তার দিকে টর্চের আলো ফেলল একবার, নিভিয়ে দিল। শেষে বলল, তুমি যাকে পালিয়ে আসা বলছ আমি তাকে পালানো বলি না। আমরা চলে এসেছি। আমাদের কি নিজের খুশিমতন চলে আসার অধিকার নেই? তুমি আমায় নাবালিকা ভাবছ নাকি?
নীলেন্দু বলল, না, তোমায় আমি সেসব কিছু ভাবিনি। তুমি সাবালিকা; তোমার বয়েস বোধ হয় বছর বত্রিশ হল; আমার মাথায় মাথায় ছুটছ। খুকিপনার বয়েস তোমার নেই, যে অবস্থা ঘটলে মেয়েরা সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে পুরুষমানুষের হাত ধরে বাড়ি ছাড়ে সে অবস্থাও তোমার হয়নি। তুমি বয়সের দোষে বা টানে যে ঘর ছাড়নি তা আমি জানি, দেবীদি। তুমি মহীদাকে তোমার আঁচলের আড়ালে ঢেকে রাখার জন্যে পালিয়ে এসেছ।
দেবযানী বিরক্ত হল না, রাগ করল না, বলল, তোমার মহীদা কি আমার আঁচলের তলায় থাকার মানুষ! যদি তেমন স্বভাবের মানুষ হত ওতবে অনেক আগেই আমি ওকে ঢেকে নিতুম।
নীলেন্দু ঘাড় ফিরিয়ে দেবাযানীর দিকে তাকাল। বলল, মানুষ যখন হেরে যায় তখন নিজের লজ্জা বাঁচাবার জন্যে সে সুবিধেমতন কৈফিয়ত খাড়া করে। মহীদা যে তোমার প্রেমের টানে, তোমার খাতিরে পালিয়ে এসেছে–এই কথাটা বোধ হয় মহীদা আজ মনে মনে স্বীকার করবে। দোষ নিও না দেবীদি, আমি তোমার ভালবাসাকে তুচ্ছ করতে চাইছি না, ছোট করতেও নয়, আমি তোমার সব জানি। কিন্তু, একথা কি তোমার একবারও মনে হয় না, তোমার ভালবাসার দিকে মন একটু বেশিরকম ঝুঁকে না পড়লে মহীদা এরকম করত না?
দেবযানী বোধ হয় খুশি হল না। বলল, একটা লোক যদি মনে করে তোমাদের মধ্যে সে থাকতে পারছে না, তার কি তোমাদের ছেড়ে আসার অধিকার নেই?
একটু চুপ করে থেকে নীলেন্দু বলল, যদি নীতির দিক থেকে ধরো তা হলে আমরা বলব, নেই। এখানে আমরা বলতে আমাদের সমষ্টিগত নীতি বুঝবে। ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য আমি অধিকার মানি। না মানলে, বন্ধুর মতন তোমাদের কাছে আসতাম না।
অনেকক্ষণ আর কোনও কথা হল না। পাশাপাশি দুজনে হাঁটতে লাগল। নীলেন্দুর পায়ে শব্দ হচ্ছিল না, ক্যানভাসের মোটা বুট রাস্তার শব্দ ঢেকে দিচ্ছিল। দেবযানীর পায়ে খুব মৃদু শব্দ হচ্ছিল। দুজনের দীর্ঘতায় কিছুটা তফাত রয়েছে, ছায়ার মতন পাশাপাশি চলে যাচ্ছে তারা। দেবযানী সাধারণ মেয়ের তুলনায় সামান্য দীর্ঘ, গায়ের শাল মাথায় তুলে জড়িয়েছেফলে নীলেন্দুর মাথা ছুঁয়ে ফেলার মতন দেখাচ্ছিল। সামান্য দুরে রেলফটক। একটা লাল বাতি জ্বলছিল জ্বলজ্বল করে।
নীলেন্দুই আবার বলল, তুমি যে আমাদের বিশ্বাস করোনি, পছন্দ করোনি–এটা তো নতুন কথা নয়, দেবীদি। সকলেই সেটা জানে। তোমার অপছন্দ অবিশ্বাস সত্ত্বেও মহীদা আমাদের মধ্যে ছিল। যতদিন ছিল ততদিন তোমায় নিয়ে আমরা মাথা ঘামাইনি। যখন আর মহীদা থাকল না–তখন বেশ বুঝতে পারলাম, তুমি তাকে আস্তে আস্তে দুর্বল করে দিয়েছ। এই দুর্বলতা মুখ ফুটে স্বীকার করা লজ্জার। কিংবা স্বীকার করলেও সেটা মুখের কথা হবে তার বেশি কিছু নয়। মোদ্দা কথাটা এই, মহীদা তোমার টানে আমাদের ছেড়েছে; তুমি তোমার ভালবাসার মানুষটিকে নিরাপদে এবং নির্ঞ্ঝাট রাখার জন্যে আমাদের সংস্রব ছেড়ে পালিয়ে এসেছ। ভয়ে। এটা পালানো ছাড়া আর কী।
দেবযানী হাতের টর্চটা জ্বেলে ফেলল। বোধ হয় অস্থিরতার জন্যে রাস্তায় আলো ফেলল, পাশের মাঠে ফেলল, শূন্যের চারিদিকে ঘোরাল, তারপর নিবিয়ে দিল।
যদি তাই হয়, তাতে ক্ষতি কী? দেবাযানী এবার শক্ত গলায় বলল।
ক্ষতি কী, তা তোমায় চট করে বোঝাতে পারব না। আগেও অনেকবার এ নিয়ে তোমার-আমার মধ্যে বচসা হয়েছে। ও কথাটা এখন থাক; আপাতত ধরে নাও, যেজন্যে তুমি পালিয়ে এসেছ, যদি সেটা না হয়।
দেবযানী যেন ভাল বুঝল না, নীলেন্দুর দিকে তাকাল। মানে?
মানে–মহীদাকে তুমি এখানে টেনে এনে যতটা নিরাপদ করতে চেয়েছ ততটা নিরাপদ সে নয়।
তুমি যে আমায় এই কথাটা বোঝাতে এসেছ, এ আমি আগেই সন্দেহ করেছি।
কী যেন ভাবল নীলেন্দু, তারপর আচমকা বলল, ঠিকই করেছ… তুমি কি আমার ব্যাগের মধ্যে হাত দিয়েছিল?
না। কেন? দেবযানী অবাক হয়ে গেল।
আমার প্যান্টের, যেটা গাড়িতে পরে এসেছিলাম, তার ভেতর দিকে চোরা পকেটে হাত দিয়েছ?
না, দেবযানী কেমন ভয়ের গলায় বলল।
নীলেন্দু বলল, যদি দিয়ে থাকো তবে আগেই জেনেছ। যদি না দিয়ে থাকো তবে তোমার কাছে বলতে আপত্তি নেই, বিশ্রী, একটা জিনিস আমি কলকাতা থেকে বয়ে এনেছি। সেটা তোমার মহীতোষকে মোটেই নিরাপদে রাখার উপযুক্ত নয়।