তুষার কপাল থেকে চুলের গুচ্ছ সরাল। ভাল করে গুছিয়ে বসল। গাড়িটা আর তাকে অস্বস্তি দিচ্ছে না। অন্ধকারের মোম ঘষা পৃথিবী কেমন নরম হয়ে এসেছে।
এবার চাঁদ উঠবে। আদিত্য বলল।
আজ ষষ্ঠী, এতক্ষণে ওঠা উচিত। তুষার আকাশের দিকে তাকাল।
চাঁদ ওঠেনি এখনও, উঠবে বলে আকাশের একদিকে অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে।
তোমাদের শিশুতীর্থ–আদিত্য হাত বাড়িয়ে অদুরের দু একটি মৃদু আলো দেখল।
তুষার বুঝতে পারল, সাহেবদাদুর ঘরে বাতি জ্বলছে, বাতি জ্বলছে আশাদির ঘরে, আরও কোথাও কোথাও। জোনাকির আলোর মতন বিন্দু বিন্দু আলোগুলো দেখে তুষার অনুভব করল, সে আর-এক জগত পেরিয়ে নিজের জগতে এসে পড়েছে।
ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে হঠাৎ ডেকে উঠল। আর তখনি তুষার দেখল, আকাশে চাঁদ উঠেছে, শীর্ণ চাঁদ।
শিশুতীর্থ পেরিয়ে এল গাড়িটা। চাঁদ ম্লান আলো এনে ওদের গাড়িকে পথ দেখাল এতক্ষণে। আদিত্য ঘোড়ার পিঠে আবার চাবুক মারল। ঘোড়াটা একবার পিছু দিকে লাফিয়ে উঠে হঠাৎ দ্রুততা আনল তার ছোটার বেগে।
তুষার অবলম্বনটা আঁকড়ে ধরল।
তোমার দুঃখ হচ্ছে না, তুষার? আদিত্য শুধোল।
হচ্ছে। মাথা হেলিয়ে তুষার বলল।
কীসের দুঃখ?
কীসের দুঃখ তুষার কেমন করে বোঝাবে। হয়তো সে নিজের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেই এই দুঃখ লাভ করল। সুখ পাবার লোভে সে গিয়েছিল, সুখ পেয়ে আবার সেই সুখকে হারিয়ে এল, কেননা এই দুঃখ তাকে প্রলুব্ধ করেছিল।
বললে না! আদিত্য আবার শুধোল।
তুষার অস্বস্তি বোধ করল। সে কিছু বলতে চায়, পারছে না। আদিত্যকে নিজের হিসেবটা দেখাতে বিব্রত বোধ করছিল তুষার।
গাড়ি আরও এগিয়ে এল। তুষার নিচু গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।
তুমি কিছুই বুঝতে পার না।
সত্যিই তুষার কিছু বুঝতে পারে না। সে বুঝতে পারছে না, কেন সে আদিত্যর সঙ্গে এই অভিসারে এসেছিল। সে জানত, তার অভিসার সত্য নয়, সে আদিত্যকে গ্রহণ করতে পারবে না, সে এই ছেলেমানুষির খেলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারবে না, তবু সে এসেছিল। কেন?
হয়তো তুষার তার মহিমা দেখতে চেয়েছিল, হয়তো তুষার জানতে চেয়েছিল, সে মলিনার ঊর্ধ্বে কি না, হয়তো তার ইচ্ছা হয়েছিল এই খেলায় সুখ কেমন তা অনুভব করবে।
আদিত্য পথে আলো পেয়ে ঘোড়াটাকে চাবুক কষাচ্ছিল। পর পর। আর বন্য ঘোড়াটা দুরন্ত হয়ে উঠেছিল, সে যেন হিংস্র উন্মত্ত। তার গতিতে কোনও সংযম ছিল না, সাবধানতা ছিল না।
ঘোড়াটা বড় খারাপ ছুটছে। তুষার বললে শঙ্কিত গলায়।
আর সামান্য পথ। আদিত্য জবাব দিল।
এই ভয়ে কি তুষার এতক্ষণ পরে নিজের চেতনাকে আবিষ্কার করল! অকস্মাৎ তুষারের কাছে এই রাত্রির রহস্য মরে গেল।
যে জগত তুষারকে মোহাচ্ছন্ন আবৃত ও পৃথক করেছিল, এখন সেই জগত স্বপ্নের জগতের মতন দূরে পড়ে থাকল। খেলার জগৎ থেকে ফিরে এল তুষার, ফিরে এসে দেখল, পথের ধুলোয় চাঁদের আলো মেটে রং ধরে আছে, মাঠ-ঘাট তার চেনা, দেখল, ট্রেন লাইনটা সামনে।
নিজের প্রাত্যহিক জগতের দিকে তাকিয়ে তুষারের মনে হল যে জগত থেকে সে ফিরে এল তার সবটাই সোনার ছিল, স্বর্গের। তার খেলনাগুলো কেবল দ্যুতি ঠিকরে দেয়, তারা চোখকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে, সেই মণিমাণিক্য বিহ্বল হয়ে দেখার মতন, কিন্তু তাকে ব্যবহার করা যায় না।
তুষার এমন খেলনা নিয়ে কিছু করতে পারত না। তার ব্যবহারযোগ্য জিনিস ওটা নয়।
গাড়িটাকে আদিত্য আরও বেপরোয়া ভাবে ছোটাচ্ছিল। যেন তার কোনও দিকে গ্রাহ্য নেই, মমতা নেই। দুরন্ত কোনও নেশা তাকে ছোটাচ্ছে, কিসের আক্রোশ তাকে উন্মত্ত করে রেখেছে।
ধাবমান গাড়িতে বসে তুষার অনুভব করতে পারল, আদিত্যর প্রেম এই রকম, অসাবধান অসতর্ক, দুঃসাহসী ও দুরন্ত; অতি দ্রুততায় তার সমস্ত উত্তজনা প্রখর পৌরুষের মতন দেখায়, অথচ এমন অনিশ্চয় যে, যেকোনও সময় তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে পারে।
তুষার স্বীকার করল, জীবনকে এমন করে সে অনিশ্চয়ের মধ্যে ফেলে দিতে পারত না। হয়তো স্তিমিত শান্ত সুস্থির কোনও ভালবাসা সে কামনা করেছিল। হয়তো মলিনা তা পাবে। পাক। তুষার জ্যোতিবাবুর জন্যে আন্তরিক কষ্ট পেল। অনুভব করল, তার হৃদয়ে শূন্যতা বিচরণ করছে।
রেল লাইনের লোহায় অশ্বখুরের স্ফুলিঙ্গ তুলে গাড়িটা লাফ মেরে অন্য পারে চলে গেল।
ভীত কণ্ঠে তুষার বলল, আমায় নামিয়ে দিন।
আদিত্য তুষারকে নামাল না।
.
বাড়ির কাছে এসে আদিত্য গাড়ি থামাল। তুষার নামল। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল। এই ভ্রমণ যে কী ভয়ঙ্কর তুষার যেন এখন তা সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারছিল।