না। আদিত্য ছেলেমানুষের গলায় জবাব দিল।
না ফিরে তারপর?
কিছু না। আমরা বসে থাকব।
পাগলামি। তুষার বিষণ্ণ মধুর করে হাসল।
আদিত্য তুষারের আঙুল নিজের ঠোঁটে রাখল! ফুলের পাপড়ির মতন আলগা করে বুলোতে লাগল।
তুমি ওই গানটা কেন গাইলে, তুষার। আদিত্য কাতর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, যেন অভিমানের পর এখন সে আঘাত প্রকাশ করছে। এই মণিহার তোমায় কেন সাজবে না?
তুষার আজ ওই গানটা গেয়েছিল। আদিত্য তাকে দিয়ে গাইয়েছিল। তুষার জানত না কী গান গাইবে। গাইতে শুরু করে তার কণ্ঠ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ওই গানের কলিটা এসে গিয়েছিল। কেন এসেছিল তুষার জানে না।
তুমি ভিতু। আদিত্য বলল, তোমার মনে সাহস নেই।
নেই।
কেন নেই?
কী করে জানব।
তুমি সমস্ত জান। তুমি জান একে ছেঁড়া কষ্টের।
একে পরাও যায় না, কষ্ট হয়।
ওটা তো গানের কথা।
আমার কথাও।
তুষার-আদিত্য পাগলের মতন মাথা নাড়ল। না, না; গানের কথাকে তুমি তোমার কথা বোলোনা । আদিত্য তুষারের করতল চুম্বন করল, তুষারের হাত দিয়ে নিজের চোখ ঢাকল। মনে হচ্ছিল এই প্রত্যাখ্যান আদিত্য স্বীকার করবে না। তুষার তুমি আমার কষ্ট দেখছ না।
কষ্ট।
আমি তোমায় কী করে বোঝাব…
আমি বুঝি। তুষার আবার হাত টেনে নিল। বলল, আর দেরি করা যায় না। ফিরতে হয়।
আদিত্য উঠল না। তার স্বাভাবিক উত্তেজনাও এত প্রখর নয়। এখন সে আরও ব্যাকুল, উদভ্রান্ত, অস্থিরচিত্ত। জ্ঞানহীনের মতন আদিত্য তুষারের পায়ে–জানুর ওপর মুখ রাখল। ফিরে গেলে তুমি আবার বদলে যাবে।
শিশির ভাবছে। অনেক রাত হয়ে গেল। তুষার আদিত্যর মাথা সরাতে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত তার চুলে হাত রাখল। কষ্ট হচ্ছিল তুষারের। এই স্পর্শ আর কোনওদিন অনুভব করবে না তুষার।
আদিত্য শিশুর মতন তুষারের জানুতে মুখ রেখে যেন কাঁদছিল। তুষার নিঃসাড় হয়ে বসে। ঘোড়াটা অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। তার পা ঠুকছিল। এই নিস্তব্ধ আবহাওয়ায় পশুটার কর্কশ ডাক বন্যজন্তুর কান্নার মৃতন শোনাল।
ওঠো! তুষার নিবিড় করে ডাকল, আদিত্যর মাথা সরিয়ে দিল কোমল করে, আর রাত করা উচিত না।
আদিত্য উঠল। ঘোড়াটা বড় অস্থির হয়ে পড়েছে। একেবারে বুনো ঘোড়া। এত অন্ধকার আর রাত্রে ওই ঘোড়াটাকে সামলে নিয়ে যাওয়া খুব মুশকিল।
.
আদিত্য উঠে দাঁড়িয়েছে দেখে তুষারও উঠে দাঁড়াল। পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার দরুন তুষার নিজেকে আদিত্যর চেয়ে অনেক দীর্ঘ মনে করল। তার মনে হল, এই উচ্চতা তাকে রক্ষা করেছে।
সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে দুটি মানুষ গাড়িতে এসে বসল। আদিত্য সামনে, তুষার পিছনে। গাড়িটা ছোট। পিছনের দিক নিচু হয়ে আছে। পাদানে পা রেখে তুষার সামনের কাঠে হাত রেখে হেলে বসল। আদিত্য ঘোড়ার লাগাম ধরে। ঘোড়াটার মুখ ঘুরিয়ে নিল আদিত্য।
জঙ্গলের পথ; গাড়িটা উঁচু নিচু রুক্ষ অসমতল পথ দিয়ে যাবার সময় লাফিয়ে উঠছিল, কাত হয়ে যাচ্ছিল। তুষার সেই ঝাঁকুনিতে গড়িয়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল।
এই রাস্তাটা তুমি জানো? আদিত্য বলল।
না।
কখনও আসোনি আগে?
কই আর এসেছি
ডান দিকে গেলে আমরা পাহাড়ে গিয়ে পড়ব।
আমরা তো বাঁ দিকে যাচ্ছি।
তোমার শিশুতীর্থের দিকে।
সামান্য সময় আর কথা হল না। ঘোড়াটা বোধ হয় তার চেনা পথের গন্ধ পেয়েছে বলে এখন খানিকটা শান্ত হয়ে পথ চলছিল। বাতির আলো এত অনুজ্জ্বল যে পথ ভাল করে দেখা যায় না। আদিত্য হাত বাড়িয়ে গাড়ির গায়ে ঝুলোনো বাতির শিখা আরও উজ্জ্বল করে দিল।
আমার ভাগ্য খুব খারাপ, তুষার। আদিত্য বলল। আমার মার ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মেছি।
উনি না আত্মহত্যা করেছিলেন?
সম্মানে লেগেছিল বলে।
আত্মহত্যায় কোনও লাভ নেই।
আমি বোকা নয়। মরব না।
আমার কেমন মনে হয়–
কী?
তুমি পাহাড়ের খারাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ। ভয় করে।
আমি ইচ্ছে করলে অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে পারি। কিন্তু দেব না।
এত বেপরোয়া, অবুঝ হলে চলে না। সংসার কেবল খরচ করার জায়গা নয়। তুমি কেন নিজেকে খরচ করে ফুরিয়ে যাচ্ছ?
আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি কিনা জানি না। একটা কিছু হয়ে ওঠার জন্যে আমি পাগল। আমার কিছু হচ্ছে না।
হবে। আরও পরে। তোমার এই অস্থির স্বভাব একদিন শান্ত হয়ে এলে তুমি নিজেকে বুঝতে পারবে।
আদিত্য কথা বলল না। ঘোড়ার খুরের শব্দ এবার কানে যাচ্ছিল, সামনের পথ অনেকটা সমতল। তুষার আদিত্যর শক্ত কালো পিঠের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকল।
খানিকটা পথ শেষ হল। এবার রাস্তা পাওয়া যাবে। আদিত্য ঘোড়াটার লাগাম আলগা করে দিল।
আমি তোমার কথা ভুলব না। আদিত্য বলল।
জোর করে কিছু বলা ঠিক না। তুষার মৃদু গলায় বলল।
আদিত্য কথাটা শুনল কিনা বোঝা গেল না। ঘোড়ার পিঠে আলগা করে চাবুক কষাল।
এই শিশুতীর্থ তোমায় কতকাল ধরে রাখবে, আমার জানতে সাধ হয়। একদিন তোমার কাছে এর দাম থাকবে না। আদিত্য মুখ ফেরাল না, সামনের দিকে তাকিয়েই বলল।
আমি জানি।
জান! আগে তো বলোনি?
আগে জানতাম না, এখন জানতে পেরেছি। তুষার নিজের মনের সঙ্গে কথা বলার মতন করে বলল। আমার ভাগ্যও খুব সুখের নয়, আমার চারপাশের দায় দায়িত্বও কম নয়।
তুমি খুব সাবধানী।
কে জানে! ..
ঘোড়াটা রাস্তা পেয়ে গেছে। আদিত্য অনুভব করল তার হাতের লাগামটা আলগা, ঘোড়াটা কদমের জোর বাড়িয়েছে।