সেও যেন কতক্ষণ, মনে হয় সময়ের হিসেব পাওয়া যাবে না। প্রতিটি মুহূর্ত যেখানে মাসান্ত বলে মনে হয় সেখানে এই দীর্ঘ সময় একটি যুগও মনে হতে পারে। কিন্তু তা নয়। কেননা ওই আকাশের এই অন্ধকার অচিরে হালকা হয়ে আসবে, আর তারপর একটি শীর্ণ চাঁদ দেখা দেবে, ষষ্ঠীর চাঁদ।
আদিত্যকে দেখা যাচ্ছে না। বৃক্ষছায়ার মতন অন্ধকারে সে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে।
তুষার হাঁটু ভেঙে বসেছিল। হাঁটুর ওপর চিবুক। তার দৃষ্টি আকাশ অথবা নক্ষত্রের শোভা দেখছে না। সামনের কয়েকটা পাথর, দু একটি বন্য চারা আর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে সে বসেছিল। প্রত্যহের স্বাভাবিক চেতনা থেকে সে ছিন্ন। যেন এই প্রকাশ্য চেতনা তার মনের অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে, তুষার তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। তার যেন সে আগ্রহও ছিল না। হয়তো এই পরিত্যক্ত নির্জন নিস্তব্ধ জগতের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করে সে তৃপ্ত। হয়তো এই নিভৃতি এবং অন্তরাল তাকে মোহাচ্ছন্ন করেছে।
আদিত্য আজ সত্যই তুষারকে মোহাচ্ছন্ন করেছে। তুষার নিজের বোধ ও জ্ঞান ওই মানুষটির কাছে কেমন করে বিসর্জন দিতে পারল সে জানে না। অথচ আদিত্য যে ক্রমশ এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তুষারের স্বাভাবিক চেতনাকে অপহরণ করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সামান্য আগে কোনও বাক্যালাপ উভয়কে অকস্মাৎ এমন এক বেদনা দিয়েছিল যারপর স্তব্ধতা ভিন্ন উপায় ছিল না। আদিত্য তুষারের কাছ থেকে উঠে গিয়েছিল, তুষার অর্ধ-আনত চোখে সামনের অন্ধকার দেখছিল।
অবশেষে তুষার নিশ্বাস ফেলল। নিশ্বাস ফেলে মুখ তুলল। সন্নিকট অরণ্যের অন্ধকার যবনিকার মতন দাঁড়িয়ে আছে। সেই যবনিকার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে তুষারের মনে হল, জীবনের এই অপ্রকাশ্য রূপটি কেন স্থায়ী নয়। কেন? কেন এই রাত্রি, এই বিচ্ছিন্নতা, এমন মুক্তি সম্ভব হয় না?
আদিত্য আবার সামনে এল। কাছে। তুষারের পাশে নিচু পাথরটায় বসে পড়ল।
সমস্যার শেষ হয় না। আদিত্য বলল আচমকা, যেন তার ভাবনার একটি অসম্পূর্ণ অংশ ব্যক্ত করল। আমরা বড় মূর্খ, সব সময় সমস্যাটাকে বড় করে দেখি।
তুষার কোনও জবাব দিল না। বাতাস তার কপালের রুক্ষ চুলের গুচ্ছ চোখে ফেলছিল। কপাল থেকে চুল সরাল নিঃশব্দে।
আমি হিসেব করতে শিখিনি। আদিত্য বলল।
আদিত্যর মুখ দেখল তুষার। দেখা যায় না। অন্ধকারে ছায়ার মতন হয়ে আছে।
ছেলেবেলায় একটি মেয়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। আদিত্য কী ভেবে বলল, সে খুব হিসেবি ছিল। আমায় হিসেব করে দেখিয়েছিল আমার বয়স যখন বাইশ হবে, তার আঠারো–তখন আমাদের কোথাও কোনও বাধা থাকবে না। … হিসেবটা ভুল হবার কথা নয়; তবু তার ষোলো বছরে বিয়ে হয়ে গেল এক জুয়েলারের সঙ্গে।
আদিত্যর বাল্য-প্রণয় তুষারকে উৎসাহী করল না। সেই মেয়েটি যে বয়সে হিসেব শিখেছিল, হয়তো সেবয়সে ভাল করে কিছু শেখা যায় না।
আমরা কি নিজের গড়া জগতে বাস করি? আদিত্য আগের প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করল কথাটা।
করি না? তুষার মুখ ফেরাল আবার।
না, করি না।
তবে?
জানি না। আমার কোনও ইচ্ছে নেই জানার। আমি এই বাঁচাটুকু বিশ্বাস করি। যা আমার চোখের সামনে আমার হাতের কাছে, আমার প্রার্থনা সেখানে। এর বেশি জেনে আমার কী লাভ!
কী জানি! তুষার দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।
অল্প সময় আবার নীরবতা। আদিত্য যেন আরও ঘন হয়ে এল তুষারের কাছে। কোনও মুহূর্তে প্রেমিকের মিনতির মতন তুষারের একটি হাত তুলে নিল। তুষার বাধা দিল না।
তুষার।
তুষার কথা বলল না। তার হৃদয় যেন আবার কেমন আশ্চর্য কুহকে আচ্ছন্ন হচ্ছিল।
আমার সমস্ত কিছুই ছেলেমানুষি নয়। আদিত্য তুষারের হাঁটুর এত কাছে মুখ এনেছিল যে, তুষার উষ্ণ নিশ্বাস পাচ্ছিল। তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারো।
কে অবিশ্বাস করেছে।
তুমি।
না।
তা হলে?
তা হলে কী? কেন তুষার স্বীকার করছে না, আদিত্যর ভালবাসা সে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করছে। আমি তোমার এই প্রেম আমার প্রাণকে নিতে দিয়েছি আদিত্য, আমার কোনও কুণ্ঠা নেই, আমি সুখী। তুষার যদি অবিশ্বাস না করবে তবে আদিত্যর প্রেমকে উদ্দেশ্য করে অনুচ্চারিত ভাবে এই কথাগুলো বলতে পারত। পারা উচিত ছিল। তুষার তা পারছে না। এই প্রেম তার কাছে মধুর, এর স্বাদ তাকে বহুক্ষণ পূর্ব থেকেই রোমাঞ্চিত করছিল, আদিত্যর হাতের তালুর মধ্যে কিছুক্ষণ আগে সে আরও একবার এখনকার মতন নিজেকে সমর্পণ করে বসেছিল। তখন যেন তুষার এই মুহূর্তেরও অধিক আনন্দ পেয়েছিল। এখন যেন সেই আনন্দ ঈষৎ হ্রাস পেয়েছে।
রাত হয়েছে অনেক। তুষার বলল।
আদিত্য তুষারের হাত নরম করে নিজের দিকে আকর্ষণ করল, মুখের পাশে রাখল। তুষার তার সমস্ত মমতা হাতে নির্ভর করতে চাইল। তার বুকের তলায় এখন যেন একটি তুলোর হৃদয় সমস্ত অনুভূতিকে স্নিগ্ধ কোমল করতে চাইছিল।
তুষারের নরম হাত নিজের মুখ গাল কপাল এবং চোখে রাখছিল আদিত্য। বুলিয়ে নিচ্ছিল। আহত কাতর ব্যক্তি যেমন করে স্বস্তি ও শান্তির স্পর্শ পেতে চায়, আদিত্য সেই ভাবে তুষারের করতল নিজের উষ্ণ মুখে রাখছিল।
তুষারের অঙ্গে শিহরণ ছিল। কিন্তু ক্রমশ তার স্নায়ু শিহরণকে সহনশীল করে তুলেছে।
ফিরতে হবে। তুষার বলল চাপা গলায়।