আদিত্য, তুষারের দিকে প্রত্যাশার চোখে তাকাল। আমি ঘোড়ার গাড়িটা এনেছি চলুন।
না-না। তুষার মাথা নাড়ল।
না কেন–! শিশির বলল, চলে যা না। তোর অসুবিধে কী! জিনিসগুলো দিয়ে আসবি, বেড়ানোও হয়ে যাবে।
শিশিরের মূর্খতায় তুষার রাগ না করে পারল না। কে তোকে বলেছে ঘরের কথা ঢাক পিটিয়ে বাইরের লোকের কাছে বলতে? তোর অত মাথা ব্যথার দরকার কী? যা করার তুষার করবে। এমন অসভ্য আর মোড়ল হয়েছে শিশির! তুষার ভাইয়ের ওপর বিরূপ বিরক্ত হল।
আদিত্য কি এই অপ্রত্যাশিত সুযোগই খুঁজছিল! তুষার দেখল আদিত্য যেন উৎসাহের আবেগে প্রদীপ্ত। আতিশয্য প্রকাশ করে বলল, না কেন, চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব আবার।
এখন থাক; এমন কিছু জরুরি ব্যাপার নয়।
নাই বা হল। এমনি বেড়িয়ে আসবেন। …ঘোড়াটা ভাল ছুটছে, খুব মজা পাবেন। ইউ উইল এনজয় দি রাইড।
তুষার মাথা নাড়ল। না, এখন সে যাবে না।
আদিত্য অনুমান করতে পারল তুষারের আপত্তি কোথায়, কেন তুষার যেতে চাইছে না। আহত এবং ক্ষুব্ধ দেখাল তাকে। মুখ ম্লান। আদিত্যের দৃষ্টি যেন বলছিল, আমায় অতটা অবুঝ ভাবার কী আছে? আমি কি তোমার কোনও ক্ষতি করব?
শিশির দিদির এই হেঁয়ালি বুঝতে পারছিল না। যাবার দরকার যখন তখন ঘুরে আসুক না কেন। কালকের অপেক্ষায় বসে থেকে কী লাভ! যতীনের গাড়ি যদি ঠিক না হয়! যন্ত্রের কথা কে বলতে পারে! শিশির বলল, কাল সকালে যতীনের গাড়ি ঠিক না হলে আবার সেই গজ গজ করবি। হাতের সুযোগ পায়ে ঠেলে ফেলছিস তখন জলে পড়বি।
আদিত্য তুষারকে যেন ভাল করে লক্ষ করে নিল। গলায় সামান্য জ্বালা, বলল, বেশি বুদ্ধিমানরাও মাঝে মাঝে বোকামি করে।
আবহাওয়া কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল। তুষার বুঝতে পারল, ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে। আদিত্য স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তুষার তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে, তার সঙ্গে পথে বেরোতে রাজি হচ্ছেনা। স্বভাবতই নিজেকে অপমানিত বোধ করছে আদিত্য, ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ হচ্ছে। শিশিরই বা কী ভাবছে কে জানে। দিদির এই হঠাৎ আপত্তির কারণও কি সে অনুমান করতে পারছে। তুষারের মনে হল, শিশির বরাবরই যেন এই জিনিসটা লক্ষ করছে, আদিত্যের সম্পর্কে তুষারের কেমন যেন একটা সঙ্কোচ, এড়িয়ে থাকার চেষ্টা। কেন? শিশির কি এই কেন-র দিকে তাকিয়ে কিছু ভাববার চেষ্টাও করছে! বলা যায় না। সেদিন, আদিত্যর আসার কথা শুনে তুষার যে পালিয়ে গিয়ে বসেছিল শিশির পরে তা বেশ বুঝতে পেরেছে। বুঝে বলেছিল, ভদ্রলোককে তুই অত ভয় পাস কেন। কেন ভয় পায় শিশির কেমন করে জানবে।
তুষার অস্বস্তি বোধ করছিল। হঠাৎ বলল, এখন সন্ধে হয়ে গেছে, এসময় লাভ কী গিয়ে।
ওর এই কারণ দেখানো এখন যেন খুব জলল, ছেলেমানুষির মতন শোনাল। মনে হল, নিতান্ত একটা ছুতো দেখাবার জন্যেই কথাটা বলল তুষার। শিশির আদিত্যর চোখে চোখে তাকাল, তারপর দিদিকে দেখল। যাবি তো চার পাঁচ মাইল রাস্তা, তাও গাড়িতে তার আবার সন্ধে।
আদিত্য হাসল, হাসিটা ব্যঙ্গের। সন্ধে হয়ে গেলে পথে বোধ হয় ভূত বেরোয়।
তুষার বিদ্রূপ গায়ে মাখল না। মাখলে অন্য জালে জড়িয়ে পড়তে হবে। বরং সাধারণ ভাবে হেসে বলল, আপনার ভরসায় বেরিয়ে তারপর গাড়ি উলটে মরি।
কেন? আদিত্য তাকাল।
আপনাকে ভরসা কী! যদি লাগাম সামলাতে না পারেন, তবেই মরেছি।
কথাটার কি কোনও সূক্ষ্ম অর্থ ছিল। হয়তো, হয়তো নয়। আদিত্য দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, লাগাম ধরতে পারি কি পারি না একবার ট্রায়াল দিয়েই দেখুন। …অত সহজে মানুষ মরে না–গাড়ি উলটে গেলেও নয়।
তুষার তবু হাসল। যেন হাসিতেই তার শেষ বক্তব্য লুকোনো আছে। হাত পা ভাঙে তো!
হাত পা ভাঙা এমন কিছু নয়। আবার জুড়ে যায়।
শিশির অসহিষ্ণু হয়ে বলল, তোর খালি কথা। যাবি তো যা, না হয় যাস না। অত হ্যাঁ না করার কী আছে।
আদিত্য পকেট থেকে সিগারেট বার করল। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, সাহস না পেলেই কিন্তু থাকে। কী বলুন!
তুষার যেন কী ভাবছিল। হঠাৎ বলল, বেশ চলুন। আমি কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরব।
আদিত্যর মুখ দেখে মনে হল সে সন্তুষ্ট হয়েছে। এক মুখ ধোঁয়া জানলার দিকে উড়িয়ে দিয়ে ও বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি বেরুতে হয়।
তুষার দ্বিতীয় কোনও কথা বলল না। বাইরে চলে গেল। ত্বরিতেই সে তৈরি হয়ে নেবে। চুল আর বাঁধবে না, রুক্ষ্ম চুল জড়িয়ে এলো খোঁপা করে নেবে, আর গায়ের শাড়িটা পালটে নেবে। কতক্ষণ আর লাগবে তার। সামান্যক্ষণ। ততক্ষণে সন্ধে আরও ঘন হয়ে আসবে। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে তুষার আকাশের দিকে তাকাল। তারা ফুটেছে।
.
১৫.
আকাশের তলায় অন্ধকার। যেন কালো মোম দিয়ে সমস্ত আকাশটা কেউ ঘষে দিয়েছে। তারাগুলো সেই অন্ধকারে খচিত হয়ে আছে। এখন অনেকটা রাত। কত রাত কেউ জানে না। প্রসারিত অরণ্য ওদের চক্ষু থেকে সমস্ত সংসার আবৃত করে রেখেছে। তুষার একটা বড় পাথরের ওপর বসে, আদিত্য পাশের ছোট পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে। ঘোড়ার গাড়িটা সামান্য তফাতে। তার গায়ে টিমটিমে দুটো বাতি জ্বলছে। মাঝে মাঝে ঘোড়াটা পা ঠুকছিল, কদাচিত ঊর্ধ্বে মুখ তুলে অরণ্যকে তার সম্ভাষণ জানাচ্ছিল।
তুষার নীরব। শিশুতীর্থ সে অনেকক্ষণ আগে ফেলে এসেছে। ফেলে আসাই। এখন সেই রকম মনে হচ্ছে। যেন কোন সন্ধ্যাকালে একবার সেখানে গিয়েছিল, সাহেবদাদুর পায়ে পশমের চটিটা পরিয়ে প্রণাম করেছে, ইতিকে দিয়ে দিয়েছে তুষারের সেই ভাল-লেগে-যাওয়া শাড়িটা, আশাদির সঙ্গে দেখা করেনি আর, আদিত্যর গাড়িতে চেপে বসেছে আবার। আর আদিত্য তাকে কেমন অদ্ভুত যাদুমন্ত্র বলে যেন নিয়ে এসেছে এই পাহাড় সন্নিকট অরণ্যে।